সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আলী হোসেনের ছোটগল্প : ঘোর

ঘোর

আলী হোসেনের ছোটগল্প ঘোর, আলী হোসেনের ছোটগল্প,
ছোটগল্প : ঘোর

আলী হোসেন

তিনটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের আপ বনগাঁ লোকাল পাঁচ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে এখনিই ছাড়বে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মুনির দৌড়াতে শুরু করে। দৌড়ে ট্রেন ধরা তার নিত্য-অভ্যাস। হঠাৎ খেয়াল হয়, আজ তো সে একা নেই। কয়েক কদম এগিয়েই থমকে দাঁড়ায়। পিছিয়ে আসে। রাহুলের ডান হাতটা বাঁ-হাতে ধরে আস্তে আস্তে ট্রেনে ওঠে। রাহুল অসুস্থ।

আপনি কখনও বনগাঁ লোকালে চড়েছেন? ঠিক ধরেছেন। আপনাকেই বলছি। চড়ে থাকলে ভালো, না চড়লে চলুন বেরিয়ে পড়ি। ধরুন, ট্রেনে চেপে আপনি মসলন্দপুর স্টেশনে নামলেন। ছোট্ট মফস্বল শহর। নামতেই শহরের যানজট আর দূষণ আপনাকে অক্টোপাসের মতো বেঁধে ফেলবে। এসব ঠেলে সোজা দক্ষিণমুখী রাস্তা ধরুন, বেশ কিছুটা এগোন অটো বা ট্রেলারে করে, দেখবেন সামনেই পড়বে বড়সড় বাজার। নাম বাগজোলা বাজার। কেন এমন নাম? এর সঙ্গে বাঘ বাবাজির পূর্বপুরুষের কোন সম্পর্ক ছিল কিনা? এসব জানিনে।

বাজারে পৌঁছানোর আগেই, এএএইখানটায় থামুন। এটা কলসুর মোড়। এই দেখুন, মোড় থেকে ডানদিকে ওওই রাস্তাটা সোজা পশ্চিম দিকে গেছে। এটা ধরে বেশ কয়েক মাইল এগোলেই পরপর বেশ কটা গ্রাম পড়বে। কলসুর, চাঁড়াল আটি, বেলেখালি, পারপাটনা এই সব প্রত্যন্ত গ্রাম। গ্রামগুলোর অবস্থান বেশ কৌতুহলী করে তোলে রাহুলকে। বড় পাকা রাস্তা থেকে এগুলো এত দূরে গড়ে উঠেছে কেন? বর্ষাকালে আড়াই-তিন কিলোমিটার হেঁটে যখন স্কুলে যেতে হয়, তখনই প্রশ্নটা বেশি করে উঁকি মারে ওর মনে। কাছাকাছি হলে কত সুবিধে হতো। মানুষগুলোর মাথায় কি কোন বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল না!

মুরুব্বীরা অবশ্য কিছু যুক্তি দেখান। তার কতটা যুক্তিসঙ্গত, কতটাই বা ইতিহাসসম্মত, রাহুল তার জানেনা। তবে কয়েকটা বিষয় তার মনে বেশ দাগ কেটেছে। পাকা রাস্তার ধারে বাড়ি হলে নাকি জমিদারদের খাজনা আদায়কারীদের জুলুম বেশি হতো। চোর-ডাকাতদের উপদ্রবও বাড়াবাড়ি রকমের হতো। কারণ, অপরাধ করে দ্রুত পালাতে পারতো তারা। একটা যুক্তি অবশ্য অকাট্যই লাগে তার কাছে। আশেপাশে যতগুলো প্রাচীন গ্রাম দেখেছে রাহুল, তার প্রত্যেকটাই বেশ উঁচু জায়গায় অবস্থিত। রাহুল নিজে লক্ষ্য করেছে, গ্রামের সবচেয়ে বনেদি পরিবারটির বাড়ি গ্রামের মাঝখানে, সবচেয়ে উঁচু জায়গায়। বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতেই এমন উঁচু জায়গা খোঁজা হতো সেকালে। তারপর বসতি গড়ে উঠতো। বনেদি বাড়িগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতো গরিব-গুর্বো মানুষের বসতি। তাই গ্রাম গড়ে উঠতে বড় পাকা রাস্তা বিশেষ গুরুত্ব পেত না। মুনিরের কাছে শুনেছে, অতীতের গ্রাম কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে পাকা রাস্তার তেমন কোনো গুরুত্বও ছিল না।

দু বছর আগেও রাহুলরা পায়ে হেঁটে যাতায়াত করত। যারা একটু স্বচ্ছল, তাদেরও সাইকেল ছাড়া গতি ছিল না। বর্ষা শুরু হলে শুরু হতো আর এক যন্ত্রণা। তখন সাইকেলেও চলত না। হাঁটা অথবা সাবেকি গরুর গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। আর কাঁচা রাস্তায় গরুর গাড়ি চলা মানে রাস্তার দফারফা। পুরো রাস্তা তখন হাবড়-এ পরিণত হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এমনই এক হাবড় থেকেই পার্শ্ববর্তী শহরের নাম হয়েছে হাবড়া। এই নামই এলাকার ভৌগোলিক পরিবেশের সাক্ষ্য বহন করে। দুপাশের বিশাল বিশাল বিলের বুক চিরে সাপের মতো এই এঁকেবেঁকে চলা রাস্তাটা মাঝে মাঝেই ডুব দেয় বিলের জলে। কিছুদূর গিয়ে আবার মুখ তোলে। 

এখন সময়টা পাল্টেছে। পঞ্চায়েতের সড়ক উন্নয়ন বিভাগ ঝামা ও আমা ইট ভেঙে পাইল করে রুলার দিয়ে পেস্ট করে দিয়েছে। এখন বর্ষাকাল ছাড়া সারা বছরই ট্রেকার চলে।

এইমাত্র ট্রেকার থেকে নামল মুনির আর রাহুল। কলকাতা থেকে ফিরছে ওরা। এটা রাহুলের গ্রাম। একেবারে অজ পাড়াগাঁ। নাম পারপাটনা। লেখাপড়ার চল্ এখানে নেই বললেই চলে।
—এই রায়ুলির মা, শুনিচি?
—কী রে?
—পরীদের বাড়ির উটোনে এট্টা খেজুর গাচ আচে না?
—আছে বোধয়। ক্যান্ রে?
—ও আল্লা! শুনিচনি? দেগগে কী কান্ড ঘটতেছ। যে খাচ্চে, তারই সেরি যাচ্চে।
—কী সেরি যাচ্চে রে পুঁটির মা?
—কেন, অসুক। যত কঠিন ব্যামোই হোক, একবার খালিই অদ্দেক সেরি যাচ্চে। দু’বার খেলি তো কতাই নেই। রায়ুলির এট্টু নে গেলি পাত্তিস তো! এ ক’দিন পিঁপড়ের মতো সার দে নোক এসতেচ। মুটো মুটো মাটি নে যাচ্চে। কাজ না হলি কি এতো নোক আসে? পরীর বাবা মনোতোষ কাকা, নিজি হাতে করে খেজুর গাচের গোড়া থিকে মাটি বিলোচ্চে — কথাগুলো একদমেই বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। পুঁটির মা যেন ভূত দেখেছে। রাহুলের মাও খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। কিছু একটা হয়েছে ভেবেও বলল, আমিও যাবানি। রায়ুলটার কি যে হল— দেখি দৈব মাটি খাইয়ে যদি কিছু... কথাটা বলতে বলতে পিছন ঘোরে। দেখে, রাহুলের বাবা দাঁড়িয়ে। চোখ দুটো লাল। গোল গোল করে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে দুটোরই জবা ফুলের মত লাল হয়ে উঠেছে। 
—‘যতসব নাজায়েজ কাজ!’ রাগে গর গর করতে করতে বেরিয়ে যায় মনসুর। মনসুর মিঞা হল রাহুলের বাবা।

মোড়ের মাথায় চায়ের দোকান। রাহুলদের বাড়ির খুব কাছেই এই মোড়। ট্রেকার চালু হওয়ার পরপরই মোড়ে মোড়ে দোকান বসেছে। বিদ্যুৎ এসে যাওয়ায়, সন্ধ্যায় ছোট করে বাজারও বসে। মনসুর মিয়া হাঁটতে হাঁটতে ওই মোড়েই যাচ্ছে। যাচ্ছে আর ভাবছে, কারেন্ট এসে গেরামের চেয়রাটাই পাল্টে গেচে। সোন্দে হলি চারিদিক যেন ঝলমল করতি নাগে। চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসতে বসতে বলে, “এক কাপ র চা দেদিন কালু। এট্টু কড়া করে দিস কিন্তু। শরীলটা যেন টাইট হ’চ্চে না কোন মতে।”
নামেই চায়ের দোকান। এখন ভিডিও পার্লারে পরিণত হয়ে গেছে। যদিও প্রথমে চায়ের দোকান হিসেবেই শুরু হয়েছিল। এক সময় খদ্দের টানতে টিভি এল। মোড়ের অন্য দোকানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে এলো ডিভিডি। তারপর...।
—আজ কী বই আচে রে কালু?
—চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা!
—এ তো আনকারা মাল! বাগালি কী করে?
কালু ছড়া কাটে, ‘আমার নাম কালু, মাল থেকে আলু,’ — মুখের তালুতে জিভ উল্টিয়ে মাথা নাচিয়ে চুংকুড়ি দেয়— ‘সালা যা চাই, তাই পাই।’ টিপ করে বাঁ চোখ মেরে বলে, ‘হল পিন্ট।”
—তা...লি এক কাপ লাগা।’ বাঁশের চটায় তৈরি বেঞ্চে দু পা তুলে বাবু হয়ে বসে পলাশ। পলাশ রাহুলের জিগরি দোস্ত। ইদানিং ব’কে গেছে। রাহুলের বাপের কথায়, ‘ব’কে যাওয়া বাঁদর।’ মুখে আয়েশী শব্দ করে বলে, ‘রাতে নিশ্চয়ই ইংলিশ মাল, কি বল?’
কালু ইশারা করে। ইশারার দুটো মানে। প্রথমটা ‘হ্যাঁ’। আর অন্যটার মানে, ‘চেপে যা, পাশের রাহুলের বাপ আছে তো!’ রাহুলের বাপ চা-টা আধ খাওয়া করে উঠে পড়ে,
—সমাজটা সারেখারে গেল গা! আর কত কী যে দেকতি হবে জেবনে, আল্লাই জানে!’
পলাশ জানে, এক কাপ চা-ই শো’য়ের পাস। তবে রাতের শো’য়ে পাঁচ টাকা লাগে। এ শোয়ে পলাশ কালুর ‘বাঁদা খদ্দের’। ৫০ টাকা দিলে ডিভিডি প্লেয়ার আর ডিসপ্লে ইউনিট পাওয়া যায়। কালুই যোগান দেয়। এক রাতের জন্য। 

রাহুল। পাড়ার কারো সাথেই সেভাবে কথা বলে না। একা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। ওর একমাত্র বন্ধু পলাশ। পলাশের চোখ দিয়েই ও প্রথম দেখেছে, হোম এন্টারটেইনমেন্টের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে কেমন করে মাটির ঘরের দাওয়ায় গোটা সিনেমা হলটাকে তুলে আনা যায়।
রাহুলের গ্রামে সংস্কার আছে, কুসংস্কারও আছে। আর আছে আধুনিক প্রযুক্তির সহবাস। সংস্কৃতির এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি চেহারা। রাহুল মাঝে মাঝে ভাবে, এসব থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারবো? কখনও কখনও ওর বিশ্বাসটা হিমালয়ের মতো দূর্ভেদ্য হয়ে ওঠে।
—আমি পারবো, আমাকে পারতেই হবে। 
লেখাপড়ায় সে দারুণ মনোযোগী। মাঝে মাঝে স্বপ্নের মধ্যেই পড়তে শুরু করে দেয়। সেদিন তো ঘুমের মধ্যেই মাঝ রাতে ব্যাক কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। প্রাইভেট পড়তে। মনোযোগটা আরো বাড়ে কোরআনের একটা আয়াত শুনে—বিদ্যা শিক্ষা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ’। আসলে ধর্মের প্রতি ভয় ও ভালোবাসা দুইয়েরই উত্তরাধিকার পেয়েছে বাবা মনসুরের থেকে। আর আধুনিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে মনিরের জন্য। ও হ্যাঁ, বলাই হয়নি তো আপনাদের। মুনির আসলে রাহুলের মামা। সম্পর্কে যদিও সৎ। 

রাহুলের গ্রামের ভূমির প্রকৃতি খানিকটা কুমিরের পিঠের মতো। গ্রাম থেকে ধাপে ধাপে নেমে গেছে জমির ঢাল। গভীর বিলের খাত পর্যন্ত। ভরা বর্ষায় দিগন্ত বিস্তৃত জলাভূমিকে যেন সমুদ্রের মতো দেখায়। উপগ্রহ চিত্রে চোখ রাখুন, দেখবেন গ্রামের তিনদিক জলঘেরা। ঠিক যেন ভূমধ্যসাগরের বুকে একটুকরো ইতালি, কুমিরের পিঠের মত ভাসছে।

জলাভূমি ঠিক ওপরের সমস্ত মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু খেজুর গাছ। ইদানিং গাছের সংখ্যাটা বেশ কমে গেছে। আগে প্রায় প্রত্যেক হালের উপর জোড়া জোড়া গাছ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতো। চেয়ে থাকতো অপলক, আবেগঘন দৃষ্টিতে। নিঃশব্দে বিনিময় হতো ভাব আর ভালোবাসার গোপন কথা। বছরের পর বছর ধরে। শীতের দিনে ঠোঁটে নলী আর গলায় মাটির ভাঁড় নিয়ে একে অপরের দিকে চেয়ে থাকতো বিরহী প্রেমিক-প্রেমিকার মতো। মনের কষ্ট, শব্দহীন কান্না হয়ে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো অঝরে নেমে আসতো ভাঁড়ে। এই দৃশ্য এখনো দেখা যায়। তবে বিরল। জোড়া গাছই তো এখন ‘প্রায়-নেই’-এর মতো হয়ে গেছে।

এরকমই এক জোড়া খেজুর গাছ। ওই যে দেখুন, বিলের একদম কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের গুড়ির দিকে দেখুন, একটা ষোলো সতের বছরের ছেলে। মাথা নিচু করে বসে আছে। ও-ই আসলে রাহুল। খুব মন খারাপ ওর। গভীর চিন্তায় পড়েছে মনে হয়। ওর বয়স যখন সাত কি দশ দিন, ওর মা চলে গেল। ডাক্তার বললো, পেটে থাকতে টিটেনাস না নেওয়া আর বাড়িতে প্রসব করাতে গিয়েই এই বিপত্তি। রাহুলের বাবা একথা মানে না। তার বিশ্বাস, ওপরঅলার ডাক আলি সবাইকে যাতি হয়। ওর ডাক পড়েছে, তাই চলে গেচে। নিজেকে সান্তনা দেয় এই ভেবে, রাকে আল্লা মারে কে, আর মারে আল্লা রাকে কে! রাহুলের মাঝে মাঝে মনে হয়, এটা কোন কাজের কথা! তাহলে তুমি ডাক্তারের কাছে যাও কেন? রাহুল জানে, এ কথার উত্তর তার বাপ দেবে না। তাই মনে মনেই প্রশ্ন ছোড়ে বাপকে কল্পনা করে।

রাহুলের নতুন মা মিনু। ইদানিং মায়ের সঙ্গে ওর দূরত্ব বেড়েছে। তেমন কথা বলে না। 
—কেন বলবে? সৎ মা ককনো আপন হয়!—প্রতিবেশীরা এমনই বলে। ছোটবেলা থেকে এমন কথা শুনতে শুনতেই সে বড় হয়েছে। ইদানিং রাহুলের বাবাও এমন বলছে।
—‘আগে তো বলতো।’ মিনু দাবি করে।
—‘আগে বুজতো না। একন বোজে। সৎ মা আর আসল মার ফারাক।’
মিনু চুপ করে যায়। তর্ক করার সাহস তার নেই। নেই নিজের মতামত প্রতিষ্ঠারও। চেষ্টা করলে তার পরিণতিও যে সুখের নয়, তা হাঁড়ে হাঁড়ে জানে। নিজের হাতেই যেন নিজের ভাগ্যের টুঁটি টিপে মেরেছে মিনু। ছোট বড় সবাই নিষেধ করেছিল। শোনেনি। তখন সবে বুকের উপর মাংসের দলা দুটো চাগান দিয়েছে। মনের মাঝে এক উথালি পাথালি ঢেউ। স্বপ্ন পুরের রাজপুত্তুর প্রতি রাতেই যেন কাছে আসে। দাদী মার কাছে সোনা সেই রূপকথার রাজকুমারের সাথে তার কত মিল! হলুইবা গরিব। পুরুষ মানুষের গতর আর দিলির মদ্দি ভালোবাসা থাকলি আর কী দরকার? দাউদের দুটোই আছে। তাই একাই এক অমাবস্যার রাতে, তার হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে মিনু। বছর না ঘুরতেই মেনুর স্বপ্নের সৌধ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সোনার দোকানে কাজ করার নাম করে দাউদ সেই যে ঘর ছাড়লো, বোম্বে থেকে আর ফেরেনি সে। মিনু এখন রাহুলের মা। এই ডাক শুনতেই সে বেশি ভালোবাসে।

পাড়ায় রাহুলকে তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজছে প্রিয়াঙ্কা। রাহুলের একমাত্র বোন। মা আলাদা হলেও তাদের বাপ এক। বাপের শরীরের রক্তই শক্ত করে বেঁধে রেখেছে ওদের দুজনকে। দুজনের কেউই মানে না, তারা সৎ ভাই বোন। পাড়ার কেউ কেউ যদিও এটাকে বাড়াবাড়ি বলে ব্যাখ্যা করে। ‘জোর করে কি আর সত্যিকে মিত্যে করা যায়?’ —টিপ্পনি কাটে। প্রিয়াঙ্কা মনে করে, যে সত্য সুখ কেড়ে নেয়, তা মিথ্যা হয়েই থাক না।

প্রিয়াঙ্কা রাহুলের দু’ক্লাস নিচে পড়ে। কিন্তু ভালো মন্দের বিচারবোধ যেন তার একটু বেশিই। রাহুলের তুলনায় বেশি ম্যাচিওর সে। মা বলে, মেয়েদের থেকে ছেলেদের বাড় কম। শুধু শরীরে নয়, বিবেচনা বোধেও ও রাহুলকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রিয়াঙ্কার কাজ আর কথা লক্ষ্য করলেও তা-ই মনে হয়। 
—দাদা, তুই এখানে! স্কুলে যাবি নে? বিলের মাঠে এসে দাদাকে আবিষ্কার করে প্রিয়াঙ্কা। ‘তোর না সামনেই উচ্চমাধ্যমিক’? মা শুনলে বলতো, ‘দেখো, পাকা গিন্নি’। কিন্তু রাহুল উত্তর দেয়নি। প্রিয়াঙ্কা ভাবে, দাদা শুনতে পায়নি। পিছন থেকে হাত বাড়ায়। নিচু হয়, কাঁধ ছুঁয়ে ডাকার জন্য। তখনই কানে আসে, দাদা বিড়বিড় করে কী যেন বলছে; মন্ত্র জপার মতো। গায়ে হাত দিতেই রাহুল চমকে ওঠে। পিছন ফিরে তাকিয়েই তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটতে থাকে। প্রিয়াঙ্কাও হকচকিয়ে যায়। কী করবে, বুঝতে পারে না। সেও ছুটতে থাকে, দাদার পিছন পিছন। রাতের রোগ কি দিনেও ধরল? মা বলেছিল, রাতের বেলা দাদাকে ফেরেশতায় ডেকে নিয়ে যায়। এখন তো রাত না! থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রিয়াঙ্কা। তারপর কী বুঝে, পিছন ফিরে বাড়ি মুখো ছুড়তে থাকে। 
সবজি ক্ষেতের আল ধরে দৌড়ানো যে কত কঠিন, প্রিয়াঙ্কা আগে বোঝেনি। আলগুলোর হাড়গিলে চেহারা। পাশাপাশি দু পা রাখার মতোও জায়গা নেই। মানুষ বেড়েছে, সাথে সাথে জমি তো আর বাড়েনি। তাই জমির ক্রাইসিসের চাপ পড়ছে আলে। আল দিয়ে দৌড়াতে গিয়ে মনে হচ্ছে, ব্যালেন্স রেসের ট্রায়াল দিচ্ছে প্রিয়াঙ্কা। খেতে ঘাস মারা ওষুধের বিষক্রিয়ায় আলগুলোর টাক-পড়া অবস্থা। যারা পুরনো মানুষ, তারা জানেন, দেড়-দু’হেতে আলের লোমশ বুকের কথা। সে-সব এখন ইতিহাস। 
দৌড়ানোর ফলে মাটির উপর পায়ের চাপ অনেকটা বেড়ে যাচ্ছে। তার উপর ঘাস নেই। আল-এর বাঁধনও তাই নেই বললেই চলে। যেখানে পা রাখতে চাইছে, সেখানটাই ধ্বসে যাচ্ছে। ঢুবঢাপ করে পড়ছে, আবার উঠে দৌড়াচ্ছে। বাড়িতে যখন পৌঁছালো, সারা শরীর তার রক্তারক্তি অবস্থা।

মেয়ের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় মিনু। কেন হল... কী করে হলো... ক’নে গিলি— পরপর প্রশ্নের ধাক্কায় মুষড়ে পরে প্রিয়াঙ্কা। সামলে নিয়ে মাকে ধমক দেয়, ‘তুমি একটু থামবে? দাদাকে একটু দেখো না...!
মিনু দ্রুত পা চালায়। মাঠের দিকে। মনের কোনে অজানা আশঙ্কা। কী হলো রাহুলের? ভুতে পেল, না জিনে ভর করল! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে এগোয়। এর মধ্যে সূর্যের তাপ অনেকটাই বেড়ে গেছে। চাপা আশঙ্কা মনের উপর চাপ তৈরি করছে ভীষণ। বুকের উপর কে যেন পাষাণ চাপিয়ে দিয়েছে। চালানোয় শরীরের তাপ বাড়ছে সমানুপাতে। দরদর করে ঘামছে সে। রাহুলের কিছু হলে যে সব দায় পড়বে তার ওপর। মনের উপর কি চাপও জমাট বাধছে। রোদে পোড়া তামাটে মুখের উপর থেকে মোমের মত গলে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। কিন্তু কই, কোথাও তো রাহুল নেই। তবে কি মিনুরই...!
—‘পই পই করে বারণ করলুম। ভরদুপুরে যাসনে।’ জ্বলে ওঠে মিনু। ‘বড় হয়েছিস। সমত্ত মেয়ে। মাঠে-ঘাটে ভালো মন্দ বাতাস বয়। একবার গায় লাগলি রোক্কা থাকবে? তা কে শোনে কার কতা! মেয়েকে উদ্দেশ্য করে শাসিয়ে ওঠে, ‘বাড়ি যাই আগে, তারপর তোর একদিন কি আমার একদিন। দাদাকে খোঁজার নাম করে মাঠে ঢুঁমারা, বের করে দিচ্ছি। বড় হচ্ছে, আর মাগীর যেন কুটকুটুনি বাড়ছে।
জোরের মাঠ। জলা জমি বলে এমন নাম। একসময় বছরের বেশিরভাগ দিন বিঘেত-জলে ডুবে থাকতো। এখন মজে গেছে। জমাট বাঁধা ঘাসে ভরে উঠেছে সারা জোল। দূর থেকে মনে হয়, চারপাশ সবুজ গালিচায় ঢাকা। জলা বোলে জোঁকের উৎপাতও খুব বেশি। মাঝে মাঝে বেঁধে আসা ছাগলের নাকের মধ্যে ঢুকে যায় ওরা। শিরা কেটে রক্ত খায়। শেষে নিজেই পড়ে যায়। কখনও দীর্ঘ সময় ধরে চুইয়ে পড়তে থাকে নাক থেকে।
ছাগল দুটো বেঁধে এসেছে সেই সাত সকালে। রোদ চড়ার আগেই তাদের বাড়ি আনতি হবে। উটোনের আম গাছ-তলায় বেঁধে ফ্যান পানি দিতি হবে। দেরি কললি গরমে জিব বেইরে যাবে—মিনুর চিন্তা বাড়ে। ঠিক করে, ফেরার পথে জলের মাঠ হয়ে আসবে। 
ওটা কী! টানটান হয়ে পড়ে আছে? মুখ থুবড়ে! খুন-টুন হলো না তো! বুকের ভেতরটা ধড়াস্ করে ওঠে। সামনে বকরি ছাগলটা শুয়ে পড়ে জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে। ফুলকো চোখে তাকিয়ে আছে বাড়ির দিকে। মিনুকে দেখেই এ্যাঁ-এ্যাঁ-এ্যাঁ...এ্যাঁ-এ্যাঁ-এ্যাঁ করে ডেকে ওঠে। অনেকক্ষণ মা ছাড়া সন্তান যেমন মাকে দেখলে খিলখিল করে হেসে ওঠে, দুহাত বাড়িয়ে দেয় তড়িঘড়ি, তেমনি আবেগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায় ছাগল দুটো। ছাগলের কাছে যেতেই আঁতকে ওঠে মিনু।
—‘একি, রাহুল! তুই একেনে, এভাবে?’
রাহুল উত্তর দেয় না। বিড়বিড় করে। বিরামহীন বলতে থাকে, ‘তুই আমার মায়ের সমান। বোনের মতো। আমায় ক্ষমা করে দিস।’ কথাবার্তায় কোন সামঞ্জস্য নেই। মিনু ঘাবড়ে যায়।

বিকাল থেকেই রাহুল একেবারেই বেসামাল। মাঝেমধ্যেই সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অনেকের পরামর্শে পায়ে শিকল দেওয়া হয়। রাতের আঁধারে যদি অঘটন ঘটিয়ে বসে! 
রাহুলের বাবার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কত শখ করে ছেলে মেয়ের নাম রেখেছিল। রাহুল আর প্রিয়াঙ্কা। প্রিয় নেতার ছেলে-মেয়ের নামের অনুকরণে। কত স্বপ্ন ছিল চোখে। কি হতে কি হয়ে গেল। আল্লাহ এ কোন মোছিব্বতে ফেলল! পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের এক ওয়াক্ত কাজা করেনা সে। কপালের মাঝখানটায় কালশিটে পড়ে গেছে, নামাজ পড়ে পড়ে। তবু তিনি নারাজ হলেন! অজান্তে কোন অপরাধ করে ফেলিনি তো? অন্ধের মত হাতের বেড়ায় মনের অন্দর। কোন ভুল, কোন অন্যায়? একটা বিষয় মনের ভেতর খচখচ করে; মিনুর ব্যবহার এজন্য...! যদিও সৎ মা বলে মেনু কে কড়া নজরে রাখে মনসুর। ইদানিং মায়ের সাথে কম কথা বলাটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। উপরওয়ালার উপর ভরসা রেখে নামাজের পার্টিতে দাঁড়ায়। আল্লাহু আকবার আল্লাহ...। তাকবীর শেষে তাহারিমা বাঁধে।
রাহুলের চোখ দুটো কেমন যেন কোঠরে ঢুকে গেছে। পক্ষী গোলক দুটোর খুব অল্পই দেখা যাচ্ছে এখন। মুখের গালাসি দিয়ে অঝরে ঝরে পড়ছে লালা। একটু মনোযোগ দিলে বোঝা যায় জীবের সামনের দিকটা ইষৎ বেরিয়ে আছে। কথা বলার সময় বিষয়টা বেশ নজরে পড়ছে। 
— সুবল গুনিনকে একবার দ্যাকালি হয় না?
— কেন?
— লক্ষণ দেখে তো...।
— না না। ভূত টুত না। ওর ওপর জিন ভর করেছে। ভালো মাওলানা দেখে দোয়া তাবিজ নিলি ঠিক হয়ে যাবে। মানসুরের গলায় গাঁঢ়  প্রত্যয়।
রাহুলের পায়ে শেকলটা এখনো খোলা হয়নি। ওই অবস্থায় কখনো নামাজ পড়ছে, আবার কখনো গান গাইছে। কখনো মা আবার কখনো বোনকে ডেকে জানতে চাইছে, কেউ অনুশোচনা করলে, সত্যিই কি আল্লাহ ক্ষমা করে? 
—ঠিকমতো ডাকতে পারলেই করে। 
—তাহলে তোকে মেরে আমি ক্ষমা চাইবো। করতে তোকে লাল চোখে যেন তেড়ে আসে রাহুল। তুই আমার এক নম্বর শত্রু।
মিনুর বুকটা শুকিয়ে যায়। মুহূর্তেই এমন রুদ্রমূর্তির কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না সে। ভাবে, সত্যিই সতীন-পো কখনও আপন হয় না! তবে প্রিয়াঙ্কা ওর এত আপন হলো কি করে? এ উত্তর ও মিনুর কাছে নেই। 

সকাল হতেই রাহুল দেখে তার হাতে মাদুলি। কনুইয়ের খানিকটা উপরে টাইট করে বাঁধা। গলায়ও ঝুলছে। কে দিল এসব? তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে রাহুল। দাঁত দিয়ে কারে বাধা মাদুলি ছিড়ে ফেলে। ছুড়ে ফেলে কলতলায়, কচুবাগানের মধ্যে। কিচ্ছু সহ্য হচ্ছে না তার। ভয়ংকর পাপ বোধ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। শুধু আজ নয়, দীর্ঘ দু মাস। ক্ষ্যাপা কুকুরের মত পাপাতঙ্কে ছুটে বেড়াচ্ছে রাহুল। কোথায় না গেছে, মুক্তির খোঁজে। 
শিমুলপুরের হাফেজ সাহেব। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আছে তার কাছে। মুশকিল আসানে তার জুড়ি নেই; এমনই জনশ্রুতি। চারিদিক ভারি নাম ডাক তার। চুপি চুপি সেখানেই হাজির হয় রাহুল। সবার আগে। কাক-ভোরে বেরিয়েছে। ভেবেছিল, কেউ আসার আগেই কাজ মিটিয়ে নেবে। কিন্তু হলো না। মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। গ্রামের ওহাব মিয়া পিছন পিছন হাজির। বড় নাতিটা কদিন ধরে পাতলা পায়খানা করছে। পানি পড়ে নেবে। রাহুল গা-ঢাকা দেয়। কথাটা রাষ্ট্র হলে মাথা কাটা যাবে যে! অনেক ভেবে শেষ দিকে দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়। 
—হুজুর, আমাকে বাঁচান। কিছু একটা করুন। প্রায়শ্চিত্তের একটা বিধান অন্তত বের করুন। 
—‘কোন বিধান নেই। অন্তত আমার তো জানা নেই। তুমি এখন এসো।’ হাফেজের চোখমুখ থেকে ঠিকরে বেরোয় ঘৃণার আগুন। এমন কথা কল্পনা করাও পাপ। রাহুলের চোখে চোখ রেখে বলে, ‘শুধু পাপ বলি কেন, মহাপাপ।’
রাহুলের মাথা নিচু হয়ে যায়। মুখ নিচু করে বেরিয়ে আসে। ভাবি আর আগুনের তাপে যেন গুরু মস্তিষ্ক টগবগ করে ফুটছে। শুকিয়ে যাচ্ছে বিচারবোধের অবশিষ্টাংশও। একসময় সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে যায় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন।
এখন কাউকেই সে আর চিনতে পারেনা। একমাত্র ব্যতিক্রম মনির। কেমন যেন কাছের মানুষ মনে হয় তাকে। মনির ভালো কথা বলে। রসুলপুর গ্রামের একমাত্র সরকারি চাকুরে সে। রাইটার্সে অফিস। খবর পেয়ে এইমাত্র এসেছে। 
মনির রাহুলের পায়ের শিকল খুলে দেয়। রাহুল খুশি হয়। 
—গুনিনের ঝাড়ফুঁক বা তাবিজ মাদুলি সবই ঠোঁট ও জগন্নাথ ভাই। এদের দিয়ে কিছু হবে না। রাহুলের বাবাকে লক্ষ্য করে বলে মনির।
—তবে? ভেঙে পড়ে মনসুর মিঞা। ‘যা করলি হয়, তাই কর না ভাই। আমার মাতায় কিছু ঢুকতেচ না।’
মনের অন্তরে জমাট বেধে আছে দুশ্চিন্তা। তার উৎস সন্ধান করতে হবে।। তারপর টেনে বের করতে হবে তাকে। সঙ্গে দরকার ট্রিটমেন্ট। মানসিক চিকিৎসা। বেঁধে রাখা নয়, শাস্তি নয়, ভালোবেসে আপন করে নেওয়া আর তার যন্ত্রণার ভাগীদার হাওয়াই এর প্রাথমিক চিকিৎসা। মনির ব্যাখ্যা করে। এ বক্তব্য যদিও ডাক্তার হামিদা বানুর। প্যাড লাভের বিখ্যাত সাইকো চিকিৎসক। মনিরের সাথে আগেই পরিচয় আছে। 
একটু আগেই রায়কোলার ওঝা ‘ঝালপাড়া’ দিয়ে ছাড়িয়ে গেছে। চোখ দুটো এখনো চলছে রেডি করে। অঝোরে ঝরছে চোখের জল। খাঁচায় পড়া ইঁদুরের মত আতঙ্কে গুটিয়ে রয়েছে রাহুল। এখন ‘ঝাঁটা পড়ে’ ঝাড়ানো হবে। রাহুলের বাপ-ই ডেকে এনেছে ফকির বাবাকে। জলভরা পিতলের ঘরে দাতে করে নিয়ে যাবে আসছে-কাল। তারপর...
—কেন? 
—সেটাই দুষ্টু আত্মার শাস্তি। 
—মানে! মনির বিস্মিত হয়। 
ওঝা ব্যাখ্যা করে, ‘ঘরা আসলে দুরাত্মায় বয়ে নিয়ে যাবে গো বাবু। এক সময় কষ্ট সহ্য করতি না পেরে, ঘাড় থেকি নেমি পালাবে। আমরা সব বুজতি পারবো। যাবার সময় কাছাকাছি গাছের ডাল ভেঙি তবেই যাবে। তকনই রাহুল ভালো হয়ি যাবে।
—তাই? তা দাঁতটা ভাঙবে কার? 
ওঝা ঘাবড়ে যায়। মনির বলে, ‘এই যে আপনার পাওনা। আপনি এখন আসুন। বাড়াবাড়ি করলে...।’

রাহুল খানিকটা সামলে উঠেছে। এইমাত্র প্যাভলপমেন্টাল হসপিটাল থেকে ফিরেছে সে। মনিরের সাথে। একটু ফ্রেশ হয়ে মনির বলে, ‘রাহুল, চলো তো বেরিয়ে আসি।’
রাহুল সহজ হয়। উঠে দাঁড়ায়। আমি তো পাপী মানুষ। হুজুর বলেছেন, মহাপাপী। আমার সঙ্গে আপনি বেড়াতে যাবেন? 
—পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়। শোনোনি কথাটা। 
—ভাব সম্প্রসারণে পড়েছি।
—তবে এ প্রশ্ন করলে? 
রাহুল চুপ করে যায়। মনের কথা গলায় আটকে যায় তার। কাঁটা বেঁধার মত। সব শুনে হাফেজ সাহেবের মত মনির মামা ও যদি পাল্টে যায়! কে তাকে প্যাভলভে নিয়ে যাবে। রাতে নির্ভয়ে কার কোলে মুখ গুজবে সে? মনিরের মনে আছে, প্রথম দিন একরকম ধরে বেঁধেই ক্যাবলাভে নিতে হয়েছিল। আজ তা হয়নি। ফেরার পথে ট্রেনে বসে কি যেন বলতে চাইছিল রাহুল।
মুনির রাহুলকে নিয়ে মাঠে নামে। জোড়া খেজুর গাছের গুড়িতে মুখোমুখি হয়।
নির্ভয়ে বলো রাহুল। মনের ক্লেদটাকে বের করো। ঘৃণা ভরে ছুঁড়ে ফেলো তাকে। আর কোনদিন যেন তোমাকে ছুঁতে না পারে। প্রতিজ্ঞা করো। 
রাহুল কোঁকিয়ে ওঠে, শত চেষ্টা করেও পলাশের সঙ্গে নীল ছবি দেখার কথাটা বলতে পারে না। নিজেই নিজের বিশ্বাস ভেঙেছে বলে শামুকের মতো গুটিয়ে যায়। 
ওই রাতেই, স্বপ্নে না সত্যি, কে জানে... বকরি ছাগলটাকে... ছি ছি! রক্তে ভেসে গিয়েছিল। সকালেও রক্ত চুইয়ে পড়তে দেখেছে। মা বলেছিল জলের মাঠের জোঁকে কেটেছে। কিন্তু... দুহাতে চোখ ঢাকে রাহুল : আমি সত্যি সত্যি... রাতের বেলা কিছু করে বসিনি তো? 
মুনি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। 
আমি তো ঘুমের মধ্যেই উঠে পড়ি, হাঁটতে থাকি। কখনো কাজ করি। সেভাবেই কিছু করে ফেলিনি তো? ঘোর কাটলে তো দেখলাম খোঁয়াড়ের মেঝেতে বসে আছি।
মনির হো হো করে হেসে ওঠে। রাহুল দুহাতে দু-কান চেপে ধরে। চোখ বুজে দেখে সপ্তম আসমান থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি নামছে। প্রচন্ড জলস্রোতে তার সমস্ত দেহমন যেন ভেসে যাচ্ছে। সামনে একটা মাত্র অবলম্বন। তাকে আঁকড়ে ধরতে বলছে এক সৌম্যকান্তি দীর্ঘ দেহে পুরুষ, যার দেহ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে বেহেস্তি নূর। 
------------xx----------- 
Thursday, July 09, 2009
2:19:53 AM
Ali Hossain 
H/O : Asraf Ali Nasker
Brahmapur, Battala Bazar
( Near Post Office )
Kolkata-7000 96

3187 words
Phone : 7003361372
প্রকাশিত হয়েছে। ভাষাবন্ধন, জুন ২০১০

মন্তব্যসমূহ

রচনাকাল অনুযায়ী গল্প : পড়ুন 👉 এখানে ক্লিক করে

আলী হোসেনের জনপ্রিয় গল্পগুলো পড়ুন

নূরের জ্যোতি

ছোটগল্প : নূরের জ্যোতি  — আলী হোসেন কেমনে রাখবো কুল / পটল গাছে হয়না পটল / না ছোঁয়ালে ফুল— সুর করে গান গাইতে গাইতে মাঠে যাচ্ছে নুর। সবাই তাকে নূর ব’লে বটে, কিন্তু পুরো নাম, শেখ নুর মোহাম্মদ। ফজরের নমাজ শেষ করেই মাঠে বেরিয়েছে সে। হাতে একটা স্টিলের থালা। থালায় থরে থরে সাজানো রয়েছে গোছা গোছা ফুল। ঠিক যেন পুজোর ডালি। না না, কোন সুগন্ধি ফুলটুল নয়, নয় ভোরের শিউলিও। পটলের ফুল। আগের দিন বিকাল বেলা ক্ষেত থেকে তুলে আনা পটল লক্ষ্মীর প্রিয় প্রসাদ। হৃষ্টপুষ্ট ‘পুরুষ ফুল’। ঠিক যেমন পূজোর ডালি সাজিয়ে গৃহকর্ত্রী এগিয়ে যায় গৃৃৃহ লক্ষ্মীর আঙিনায়, তার আগমনকে স্বাগত জানিয়ে, তাকে খুশি করার অভিপ্রায় নিয়ে; ঠিক তেমনি নৈবেদ্য সাজিয়ে নূর চলেছে তার গৃহলক্ষীর আবাসভূমি পটল ক্ষেতে। রোদ চড়ার আগেই তার চরণে নিবেদন করতে হবে এই পরম নৈবেদ্য। তার ছোঁয়ায় লক্ষীর প্লাসেন্টায় গেঁথে যাবে নতুন নতুন কুঁড়ি। ক্ষেতময় জেগে উঠবে শয়ে শয়ে পটল লক্ষীর নতুন অবয়ব। —‘ক’নে যাচ্চিস রে নুর?’ —রাস্তার ধারে ঝোপের আড়াল থেকে প্রশ্নটা ভেসে আসে। নুর ভাবে, করিম চাচার গলা না! যদিও করিম নূরের আপন চাচা নয়। তবে নুর ‘ফারাক’ ...

খোঁজ : প্রথম পাতা

গল্প : খোঁজ - আলী হোসেন। প্রথম পাতা ( গল্প সংকলন : দ্বিতীয় পিতা ) শুরু থেকে পড়ছেন আগের পাতা                         গল্প সংকলন                       দ্বিতীয় পাতা কীবোর্ডে স্ট্রোকের আওয়াজ। খট্-খট্‌, খট্, খট্-খট্-খট্, খট্-খট্,....। এত জোর যেন কান-মাথা ধরে যায়।! দশ-দশটি কীবোর্ড। চলছে এক সাথে। মাথার সাধ্য কি, না ধরে যায়!। এর মধ্যে ঋদ্ধির স্টোকের জোর, একটু বেশিই। বিগত দশ বছর ধরে চলছে এই কী-আঙ্গুলের ঠোকাঠুকি। তাই গা-সহা হয়ে গেছে সব। ক্রমে গভীর হয়েছে হৃদ্যতা, ঋদ্ধির সাথে কীগুলোর। কিন্তু পাশের জনের সহ্য হবে কেন? হ্যালো, শুনছেন? ঋদ্ধি বুঝতে পারেন, ওকেই উদ্দেশ্য করা হচ্ছে। একটু আস্তে স্ট্রোক দিন না! বাঁ পাশের সিটে বসা ছিপছিপে মেয়েটা বিরক্ত হয়। কীবোর্ডের খট খট আওয়াজ মাইক্রোফোন যেন লুফে নিচ্ছে। তাই সাথির কথার চেয়ে ওটাই বেশি পাচ্ছে পিউ। পিউ সাথির চ্যাট-ফ্রেন্ড। ভয়েজ চ্যাটেই ওরা বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আস্তে স্ট্রোক দেওয়ার চেষ্টা বরাবরই করে ঋদ্ধিনাথ। কিন্ত...

দ্বিতীয় পিতা

দ্বিতীয় পিতা লিখেছেন : আলী হোসেন  সকাল বেলা উঠেই চোখ দু’টো ডলতে থাকে মিরাজ। দুই হাতের মুষ্টি দু’চোখের পল্লবের উপর রেখে কব্জির মোচড়ে ডলা যা্রে বলে। বিরামহীনভাবে। মুহূর্তেই অক্ষিগোলক দুটো লাল হয়ে ওঠে, যেন জবাফুল। সঙ্গে ফুঁপিয়ে কান্না। আজ সে কোন মতে মাঠে যাবে না। গরু চরাতে ওর মোটেও ভালো লাগে না। ওর ইচ্ছা, বড় হয়ে স্কুল মাস্টার হবে। সেজন্যে যে অনেক লেখাপড়া শিখতে হবে! অথচ মা, তাকে গরু নিয়ে মাঠে পাঠাচ্ছে। বুকের ভেতরটা ভারি হয়ে আসে। মনের কষ্টে দম বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা। বুকের ভেতরের চাপটা বাড়তে থাকে ক্রমশঃ। বাড়তে বাড়তে এক সময় কষ্টের মেঘ আষাঢ়ে বৃষ্টির মত কান্না হয়ে ভেঙে পড়ে। খুব করে কাঁদতে পারলেই যে বুকটা আবার মেঘমুক্ত আকাশের মত হাল্কা হয়ে যায়, কিছু সময় গলা ছেড়ে কাঁদার পর মিরাজ তা বেশ অনুধাবন করে। ছোড়ার শক দ্যাকো, মাস্টার হবে! বলি, তোর বাপ কোনো দিন ইস্কুলির মুক দেকেলো। গরু চরানো পাচুনটা ছেলের দিকে বাড়িয়ে ধরে আচিয়া, ‘যা, গরু গুলোন চইরে আন, কাজ দেবেনি। ছেলের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, ‘কাঁচা ঘাস পেটে পড়লি গাইটার দুধ বাড়বে; এক কিলোর জাগায় দু’কিলো হবে, ইসকুলি গেলি কী বাড়বে শুনি’? কথাগুলো এখনও কানে...