সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নূরের জ্যোতি

ছোটগল্প : নূরের জ্যোতি 

— আলী হোসেন

কেমনে রাখবো কুল / পটল গাছে হয়না পটল / না ছোঁয়ালে ফুল— সুর করে গান গাইতে গাইতে মাঠে যাচ্ছে নুর। সবাই তাকে নূর ব’লে বটে, কিন্তু পুরো নাম, শেখ নুর মোহাম্মদ। ফজরের নমাজ শেষ করেই মাঠে বেরিয়েছে সে। হাতে একটা স্টিলের থালা। থালায় থরে থরে সাজানো রয়েছে গোছা গোছা ফুল। ঠিক যেন পুজোর ডালি। না না, কোন সুগন্ধি ফুলটুল নয়, নয় ভোরের শিউলিও। পটলের ফুল। আগের দিন বিকাল বেলা ক্ষেত থেকে তুলে আনা পটল লক্ষ্মীর প্রিয় প্রসাদ। হৃষ্টপুষ্ট ‘পুরুষ ফুল’। ঠিক যেমন পূজোর ডালি সাজিয়ে গৃহকর্ত্রী এগিয়ে যায় গৃৃৃহ লক্ষ্মীর আঙিনায়, তার আগমনকে স্বাগত জানিয়ে, তাকে খুশি করার অভিপ্রায় নিয়ে; ঠিক তেমনি নৈবেদ্য সাজিয়ে নূর চলেছে তার গৃহলক্ষীর আবাসভূমি পটল ক্ষেতে। রোদ চড়ার আগেই তার চরণে নিবেদন করতে হবে এই পরম নৈবেদ্য। তার ছোঁয়ায় লক্ষীর প্লাসেন্টায় গেঁথে যাবে নতুন নতুন কুঁড়ি। ক্ষেতময় জেগে উঠবে শয়ে শয়ে পটল লক্ষীর নতুন অবয়ব।

—‘ক’নে যাচ্চিস রে নুর?’ —রাস্তার ধারে ঝোপের আড়াল থেকে প্রশ্নটা ভেসে আসে। নুর ভাবে, করিম চাচার গলা না! যদিও করিম নূরের আপন চাচা নয়। তবে নুর ‘ফারাক’ করে দেখে না। বাবা মারা যাবার পর, তার অভিভাবকত্বই তো নূরকে আগলে রেখেছিল, হিমালয়ের মতো। তাই নূর তাঁকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে, প্রাণ ঢেলে। 

নূর থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু আশপাশে তো কাউকে দেখচি নে!’ মনে মনে ভাবে, উত্তর না দেওয়াটাও তো বেয়াদবি হবে। শেষমেষ উত্তর দেয়—‘ফুল ছোঁয়াতি যাচ্চি, চাচা।’ উত্তরের পর পরই জিভ কাটে নূর। যদি শোনার ভুল হয়! এত ভোরে, সত্যিই কি কেউ জিজ্ঞাসা করল তাকে! ব্যাপারটা কেমন ক্যাবলা ক্যাবলা হয়ে গেলো না তো! স্বতঃস্ফূর্তভাবে, একারণেই জিভ কেটেছে নূর।

হাতে মাটির ভাঁড়, কাঁধে সদ্য-কাঁচা গামছা। মুখে মেসওয়াক। মেসওয়াক বলা হয় বটে, কিন্তু এটা আসলে নিমের ডাল। নিম গাছের সরু সরু ডাল কেটে টুকরো টুকরো করে কেটে রাখা হয়। রোজ সকালে ওই ডাল দিয়ে দাঁত মাজে করিম। প্রত্যেক মুসলমানের এভাবে মেসওয়াক করা সুন্নত। করিম জানে, মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের এটা একটা অন্যতম মাধ্যম। নবীজি জিব্রাইল ফেরেশতার কাছ থেকে অহি হিসেবে এই নির্দেশ পেয়েছিলেন। করিম চাচা এটা মনে প্রানে মানে। অন্যকেও মেনে চলার পরামর্শ দেয়।

নূরের ভাবনা শেষ হতে না হতেই, করিম মুখে মেসওয়াক নিয়ে কচা ঝোড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। ‘বাহ্যি’ করে। সারা গ্রামে দু’চারজনের বেশি কারও পায়খানা ঘর নেই। তা সে কাঁচাই হোক, বা পাকা। করিম চাচার মত, প্রায় সকলেই এভাবেই ঝোপে ঝাড়ে বা বাঁশবাগানের মধ্যে আড়াল খুঁজে সকালের প্রাত্যহিক কাজ সারে।

নূর ভাবে, ভাগ্যিস উত্তর দিয়েছিলুম! না হলি লজ্জার এক-শেষ হতো। যতই হোক মুরুব্বি মানুষ। 
—‘পরামর্শটা কানে নিলি না নূর!’ নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত মেসওয়াক করতে করতে করিম মনে করিয়ে দিলো।
—‘কোন পরামর্শ চাচা?’
—‘ওই যে...’ নূরের হাতের দিকে ইশারা করে করিম। ‘সেদিন বললাম না, এটা নাজায়েজ কাজ।’
—‘বললে তো, কিন্তু...!’
—‘কিন্তুর কিছু নেই নূর।’ নুরকে থামিয়ে দেয় করিম, ‘খোদার ওপর খোদকারি করা সাজেনা। এতে খোদা নারাজ হন।’
নূর মাথা নিচু করে। করিম আবারও সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিয়ে চলে যায়। নূর মাথা তোলে। দ্রুত পা চালায়, মাঠের দিকে। 

মেয়েরা জলের কলসি যেভাবে কাঁখে নেয়, নুর সেভাবেই ফুলের থালাটা ধরে আছে। বাঁ হাতে। ডান হাতের তিন আঙুলে ধরে আছে ফুল। কলম ধরার মতো। ফুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে ভাবে, খোদার কী কুদরত, এইটুকু ছোঁয়ায় ফুলটা পোয়াতি হবে। ফল বিয়োবে। তবেই-না আমাদের মুখে হাসি ফুটবে! ভাবতে ভাবতে মুখ টিপে হেসে ফেলে নূর।
—‘মাথাটা গেল নাকি, ও মিলনের বাপ। আনমনে হাসতি লাগলে যে?’
—‘সে তুমি বোজবা না। হাত চালাও। রোদ ওটার আগে শেষ কত্তি হবে।’
—‘তুমি বোজালি, আমি বোজবোনা, তাও কখনও হয়েছে?’
—‘এই ফুলটারে দ্যাকো’, আঙুল বাড়িয়ে সামনেই ফুটে থাকা একটি মাদি ফুলকে ইশারা করে নূর, ‘ এর এখন কেমন অবস্থা বলোদিনি?’
—‘কেমন?’
—‘ঠিক তোমার মতো।’
—‘মানে!’
—বুঝলে না তো? জানতাম, তোমার মোটা মাতায়, এসব ঢোকবে না।’
পটলের মাচার দু’দিকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এভাবেই মাঝে মাঝে খুনসুটিতে মাতে নূর ও তার স্ত্রী। ফুল ছোঁয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে। এই মাচা তৈরির আগে, তারা ভালো করে মাটি চোষে নেয়। এরপর এক হাত অন্তর আড়াই হেতে পিলি দেয়। পিলির দুই ধার বরাবর পোঁতা হয় পাঁচ হাত অন্তর এক একটা চটা। বাঁশ লম্বালম্বি ফেড়ে আড়াই হাত অন্তর কেটে নিলে চটা বের হয়। এই চটার মাথা বরাবর টানা হয় তার; ক্ষেতের এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত। তারের দুই মাথায় চটা থেকে এই তারগুলো নেমে আসে মাটিতে। এবার মাটিতে পুতে রাখা খোঁটায় তারগুলোকে পেঁচিয়ে টান টান করে বাঁধা হয়। নূররা একে ‘টানা’ বলে। এভাবেই তৈরি হয় পটল ক্ষেতের মাচা। সমস্ত মাচাটাকে এই ‘টানা’ই টেনে ধরে রাখে শক্তভাবে।
—‘একটু খুলিঢেলি বলো না, ঠিকই বুজতি পারব’। মিলনের মা গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে।
—ওই যে গো! তোমার ওই পাঁচটা দিন...। গতকাল যার জন্যি কাপড়চোপড় কাঁচলে। পাক সাফ হলে...। ... এখনও বুজলে না? আরে...!, এই ক’দিন যার জন্যি ফুল ছোঁয়াতি এলে না।’
এবার নূরের ইঙ্গিত বুঝে ফেলে মিলনের মা। লজ্জায় চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে তার।
—‘তোমার দেকছি মুকের আল-টেকর নেই। ঝা মুকি আসে তাই বলে দ্যেও।’ চারপাশ ভালো করে দেখে নেয় মিলনের মা। তাদের কথা কেউ শুনে ফেললো না তো!
—‘খুব নজ্জা দেক্চি! কাল রাত্রিরি, আমার ঠোঁটটার যে বারোটা বাজালে। এখনো ঠোটের উপর দাঁতের দাগটা দগদগ ক’চ্চে। তখন নজ্জা ক’নে ছেলো তোমার?
চারপাশে কেউ নেই দেখে, মিলনের মাও সহজ হয়ে যায়। 
—তা যা বলেচো। এই সময় দেহটা ঝ্যানো হাহাকার করতি লাগে। তোমাকে শুদ্ধু খেয়ে ফেলতি ইচ্চা করে। একটু ভারি নিশ্বাস ছেড়ে বলে— ‘এই জানো, বড়ো বু বোলতেলো, এই সময় নাকি খুব সাবদানে মেলামেশা কত্তি হয়। না হলি...’
—‘পেট বেদি যেতি পারে, তাই তো?’
মুখ টিপে হাসে মিলনের মা। 
—‘ফুলগুলোরও এখন ঐরকম অবস্থা। ছোঁয়ালিই পেটে ছাওয়াল আসবে। এখন তোমার যেমন।’
—‘যা! তাই হয় নাকি? কোতায় মানুষ, আর কোতায় গাচপালা।’
—‘না হলি, আমরা ফুল ছুয়াচ্চি কেন?’

মিলনের মা লেখাপড়া জানে না। তাই এসব বোঝেনা। নূরও বেশি জানে না। তবে বোঝে। পঞ্চায়েত অফিসে কৃষি সহায়কের কাছ থেকেই নূর এসব জেনেছে। নারী-পুরুষের মিলনে যেমন সন্তান হয়, তেমনি স্ত্রী ফুলের সঙ্গে পুরুষ ফুলের মিলনে হয় ফল। ‘কেমন সোন্দর করে বোজালেন সেদিন’, মিলনের মাকে উদ্দেশ্য করে বলে— ‘মোদের যেমন শুকরাণু, ফুলের তেমন পরাগ। তোমাদের ডিমবাণু, ফুলেরও তা-ই। সব এক। শুকরাণু আর ডিমবাণুর মিলনে যেমন সন্তান, তেমনি পরাগ আর ডিমবাণু মিলে হয় ফল।’ সেই থেকে কৃষি সহায়কের পরামর্শেই নূর পটলের ফুল ছোঁয়ায়। নূরের ফলন বেড়েছে দেখে অন্যরাও তা-ই করে।

মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কাঁচা পাকা মিলে আশি ভাগ তো হবেই। বয়স খুব বেশি না। তবু যেন বুড়িয়ে গেছে। নূর শুনেছে, যারা সবজি খেতে নিয়মিত বিষতেল স্প্রে করে, তাদের তাড়াতাড়ি চুল পেকে যায়। সত্যি মিথ্যা সে জানে না। তবে প্রতিদিনই তাকে কোনো না কোনো জমিতে স্প্রে করতে হয়। আর তারও চুল পেকে যাচ্ছে। দু’য়ে মিলে ধারণাটা তাকে ভাবায়।
মনে মনে ভাবে, ‘ভেবেই বা কি ক’রবো। কষ্টমষ্ট করে একনো পাঁচটা বচর এভাবেই চালাতি হবে। মিলনটারে এমএসসি পন্ত পড়াতিই হবে, যেমন করে হোক।’
নিজে লেখাপড়া শিখতে পারেনি বলে তার খুব আপসোস। আর হবেই বা না কেন? তার চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোট আজিবর। তার প্রতিবেশী বন্ধু। হঠাৎ আব্বা মারা গেল। ক্লাস এইটটা আর পাস করা হলো না। আজীবর পাশ করে মিলেটারিতে গেল। হোক না কাপড় কাঁচা কাজ। চাকরি তো! আজিবারকে যেদিন হাওড়া স্টেশনে তুলে দিতে গিয়েছিল, চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য, সেদিনই সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ‘আমার তো আর হোলো না, আমার যদি আল্লাহ একটা ছেলি দেয়, তাকে আমি লেকাপড়া শেকাবুই। তাতি আমার যত কষ্টই হোক।’

মিলন এবার বিএসসি পড়ছে। ফার্স্ট ইয়ার। বটানিতে অনার্স নিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই জোরে জোরে শব্দ করে পড়া তার অভ্যাস। ছেলের পাশে বসে অপলক চেয়ে পড়া শোনাটা নূরের অভ্যাস। ছেলের পড়া শুনতে শুনতে, মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করে নূর। মিলন প্রথম প্রথম বিরক্ত হতো। এখন আর হয় না। যা জিজ্ঞেস করে, বলে দেয়। মিলন আগে ভাবতো আব্বা সব জানে। বোঝেও। এখন জানে, সে সবই মিথ্যা। 
আসলে মিলনের বাবা লেখাপড়া বিশেষ জানে না, এটা বুঝতে পেরে যদি মিলন পড়ায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, তাই নুরের এই অভিনয়। লড়াইও বটে। যেন সব জানে —এটা বোঝাতেই ছেলের পড়া শুনেশুনেই ছেলেকে প্রশ্ন করে। কবে কবে যেন গাছপালার জীবনচক্র সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা তৈরি করে ফেলেছে নূর। 
শুধু কি তা-ই। নুর এখন জানে, সে এক ঐতিহাসিক গ্রামের বাসিন্দা। ছেলেই একদিন বলেছিল, ‘জানো আব্বু, আমরা এক বিখ্যাত গ্রামে বাস করি।’
—মানে?
—তুমি তিতুমীরের নাম শুনেছো?
—‘শুনিচি। তাঁর নামে বারাসাতে একটা বাস স্ট্যান্ড রয়েছে। আগে নাম ছেলো চাপাডালি বাস স্ট্যান্ড।’
—‘উনি আমাদের গ্রামেরই মানুষ। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন।’

হায়দারপুরের কেউই এই গ্রামের ইতিহাস নিয়ে আজ আর মাথা ঘামায় না। অনেকে তো জানেই না। তত সময়ই বা কই মানুষের? ইংরেজ চলে গেছে নয়-নয় করে ছয় দশক পার হয়ে গেল। সে সব তারও বহু বছর আগের কথা। সরকারি আমলা, নীলকর সাহেব আর হিন্দু-মুসলিম জমিদারদের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম শুরু করেছিলেন মীর নিশার আলী। আমাদের ‘তিতুমীর’। কিন্তু জেতা আর হয়ে ওঠেনি।
এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু তিতুমীরের সেই গ্রাম, যে’ তিমিরে ছিল, সে’ তিমিরেই রয়ে গেছে। অশিক্ষা আর অনাহার গ্রামটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। অক্টোপাসের মতো। সেখান থেকে বেরোনোর কাজ খুবই কঠিন। ৯০ এর দশকে সাক্ষরতার আন্দোলন হয়। কোনো কোনো জায়গায় এর দারুন প্রভাব পড়েছিল। নূর জানে। বয়স্ক মানুষদের লেখাপড়া তেমন কিছু হয়নি বটে, তবে তাদের মধ্যে লেখাপড়া সম্পর্কে চেতনা বেড়েছে। তাই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্দোলনটা ব্যর্থ হয়েছিল। মনে হয় নূরের। হায়দারপুর গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

শিয়ালদা-বনগাঁ লাইনের দু’ধারে বিস্তৃত মফস্বল শহর মসলন্দপুর। এই শহরের রেল স্টেশন থেকে বাসে কুড়ি পঁচিশ মিনিটের পথ। পেরোলেই পদ্মা। স্থানীয় নদী। এর পাড়েই গড়ে  উঠেছে মগরা। একটা ছোট্ট গঞ্জ। দোকানপাট বিশেষ নেই। দুটো চায়ের দোকান, একটা মুদিখানা। সবই চাঁচের বেড়া দিয়ে তৈরি। একটা মিষ্টির দোকান অবশ্য আছে। তবে তাতে মিষ্টির চেয়ে মাছির সংখ্যাই বেশি। কাছে গেলে বোঁওও শব্দে মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম হয়। কয়েক বছর আগেই পদ্মার ওপর নতুন ব্রিজ হয়েছে। ব্রিজ পেরোলেই যে রাস্তাটা বাঁ হাতে নেমে গেছে, সেটা ধরে ঘণ্টাখানেক হাটলেই হায়দারপুর গ্রাম।
রাস্তার দুপাশে, অধিকাংশই পোড়ো জমি। বুনো আগাছায় ভরা। ইদানিং কোনো কোনো জায়গায় আমের বাগান লাগানো হয়েছে। কিছু জমি এক ফসলি। কিছু জমিতে একেবারেই ফসল হয় না, বাচড়া। এক ফসলিতে শুধুমাত্র সবজি চাষ হয়। কাঁচা লঙ্কার চাষই বেশি। এছাড়া বেগুন, বরবটি, কপি এবং কোনো কোনো জায়গায় আখের চাষ হয়। এরকমই সবজি চাষের দু বিঘে জমির মালিক নূর। সবজি চাষেও হ্যাপা অনেক। পুকুর থেকে সেউতি দিয়ে জল তুলে জমিতে দিতে হয়। আলের গা বরাবর পড় কাটা। একেবারে ক্ষেত পর্যন্ত । জমিতে জল যাওয়ার নালাকে ওরা ‘পড়’ বলে। এই পড় দিয়েই জল ক্ষেতে যায়। দারুন খাটনির কাজ। 
গ্রামের অনেকেরই নিজস্ব জমি নেই। তাদের কেউ ভাগ চাষী, কেউ বা বর্গাদার। ‘জ্যোতিবাবু এই এট্টা কাজ দারুন করেলো। যে লোক যে জমিতে চাষ করতো, তাকে সেই জমির পাট্টা দে দিয়েলো’— বর্গা চাষিরা এভাবেই ব্যাখ্যা করে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে। কেউ আবার লোহা কুড়ানোর কাজ করে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাঙাচোরা লোহা কেনে। সঙ্গে টর্চ লাইটের ব্যাটারি, প্লাস্টিকের ভাঙ্গাচোরা জিনিস। সেগুলো আড়তদারের কাছে বেচে পেটের কোন রকমে ক্ষিদে মেটায়।
রাস্তা দিয়ে হাটলেই চোখে পড়ে ছোট ছোট বাচ্চারা ব্যাটারি ভাঙছে। আড়তে। ব্যাটারি ভেঙে কার্বন দণ্ড বের করছে তারা। বাড়ির মেয়েরা বারান্দায় বসে। রাখি তৈরির কাজে ব্যস্ত। কেউ কেউ আবার উঠানে আম গাছের নিচের ছায়াকে বেছে নিয়েছে। প্রখর তাপে এটাই তাদের কাছে শীতাতপ  নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
নূর তার ছেলেকে ব্যাটারি ভাঙতে দেয়নি। বউটা মাঝে মাঝে রাখি তৈরি করে বটে। তবে নিয়ম করে মাঠেও যায়। নূরের সঙ্গে। আজ যেমন গিয়েছিল। 

অনেকদিন আগের কথা, নুর উঠানে একটা আম গাছ লাগিয়েছিল। এনেছিল গোবরডাঙ্গার ‘গোষ্ঠবাড়ির মেলা’ থেকে। মেলাটা বসত গোবরডাঙ্গার জমিদার বাড়ির সামনে। যমুনা নদীর ডান পাড়ে। গাছটা সেখান থেকেই নেওয়া। কলমের হওয়ায়, ফল ধরেছিল দু’বছরের মাথায়। এখন সে অনেক বড় হয়ে গেছে। শুধু আম নয়, এখন ছায়াও দেয়। বহুদিন হল, এই আম গাছের নিচে বাঁশের ‘ওটা’ বেঁধেছে নূর। কাঠফাটা রোদের সময়, কিম্বা প্রচন্ড গরমের রাতে ওটার ওপর খেজুর পাতার চাটাই পেতে বিশ্রাম নেয় সে। ফিরফির করে বাতাস এসে গা জুড়িয়ে দেয়। যেন মায়ের হাতের আদর মাখা পাখার বাতাস। বয়ে যায় সমস্ত শরীর আর মন জুড়িয়ে।

আজ ওটার মধ্যমণি করিম। নূরের করিম চাচা। পাশে করিমের তালবেলেম। নিচে মাটিতে চাটাইয়ে বসা জনা পঞ্চাশেক মানুষ। সকলেই এ গ্রামের। 
—‘পটলের ফুল ছোঁয়ানোটা বন্ধ করা উচিত’—সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে করিম। যদিও তার বিশেষ লক্ষ্য ছিল নূর। 
—‘তা-ই হয় নাকি? জামাল দাঁড়িয়ে উঠে বলে, ‘একে এক-ফসলী জমি, তার ওপর ফুল না ছোঁওয়ালি গাছে ফলই ধরে না।’ চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।
নুর বলল, ‘অপরাধ নিও না চাচা, ফুল ছুঁয়ানো নাজায়েজ কেন, যদি একটু বুঝগে বলেন!’
—‘এতো পানির মত সোজা।’ নারী পুরুষের মিলনে সন্তান হয়। এই মিলনের সাক্ষী থাকে শুধুমাত্র ওই দুজন মানুষই। আর আল্লাহ তো সবজান্তা। সকলের দিকে তাকিয়ে বলে করিম। 
কেউ শব্দ করে, কেউবা নিঃশব্দে সম্মতি জানায় মাথা নেড়ে। 
—‘তো!’ জামাল বিস্ময় প্রকাশ করে।
—‘এখানে যেমন তৃতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি নাজায়েজ, তেমনি ফুলেদের একান্ত মেলামেশায় নাক গলানোও তা-ই।’
শুনে অনেকেই মাথা নাড়ে। করিমের এলেমের তারিফ করে।
মিলন ঘরের ভেতর পড়ছিল। বাইরের আলোচনা এড়ানোর জন্য ঘরের দরজাটা বন্ধ করে রেখেছিল সে। কিন্তু কানটা সব বাধা অতিক্রম করে বাইরে চলে যাচ্ছিল বারবার। ক্রমশ আলোচনায় গেড়ে বসে তার মনটাও। কিছুতেই বেঁধে রাখতে পারছে না তাকে। হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে।
—কিন্তু দাদু, গাছেদের এই মেলামেশা তো তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতেই হয়। শুধু তা-ই নয়, এখানে একাধিক জনের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকে।’
মুহূর্তে সকলের নজর মাটির বারান্দায় চলে যায়। কেউ দারুণ আগ্রহ নিয়ে। কেউবা প্রচন্ড বিরক্তিতে তাকায় মিলনের দিকে। —‘মিলন, তুমি ঘরে যাও।’ শাসনের সুরে নূর বলে, ‘বড়দের কতায় নাক গলাতি নেই বাবা।’
মিলন মাথা নিচু করে ঘরমুখো হয়। 
জামাল বলে, ‘যাবার আগে মিলনের কতার ব্যাক্যা দিতি হবে। আমরা জানতি চাই।’
মিলন ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা দেয়। দিনের বেলায় কীভাবে সকলের সামনে একাধিক পতঙ্গের সহবাসে একটা ফুল গর্ভবতী হয়। জামাল সহ কয়েকজন মিলনের তারিফ করে। —‘এইজন্যিই লেকাপড়া শেকা দরকার।’
কেউ কেউ কানাকানি করে, ‘দেখলি, লেকাপড়া শিকে ছেলেটা কেমন গোল্লায় গেচে। এতগুলো মুরুব্বি মানুষের সামনে দেড়গে, কেমন বেহায়ার মতো বলে গেল কতাগুলো। একটু শরম করল না!’
—‘নূরেরই বা কী আক্কেল? মোছনমান হয়ে ছেলেকে বলে কিনা ‘বাবা’! কেন আব্বু বলতি নজ্জা নাগে !’
—‘মাদ্রাসায় না দিয়ে কাফেরদের তৈরি ইস্কুলি পড়ালি এরামই হয়।’
—‘বুঝলি না, নতুন কাগে গু খাতি শিকেচে। ধরাকে সরা মনে কত্তিছে একন।’
করিম চাচা বলল, ‘মিলন যা-ই বলুক, ফুল ছোয়ানোটা খোদার উপর খোদকারী করা। আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু হয়। আল্লাহ চাইলে ফুল না ছোঁয়ালেও পটল হবে।’
করিম চাচার তালবেলেম বলল, ‘পৃথিবী ঝখন পাপে ভরে যায়, তখন আল্লাহ গজব দেয়। হতি পারে, এটা একটা গজব। তাই পটল হচ্চে না। চারিদিকি যেভাবে অনাচার চ’লতেছে!
—‘আমরা যদি আল্লাহর এই ইচ্চার বিরুদ্ধে যাই, তালি কিন্তু আরও বড় মছিব্বতে পড়তি হবে আমাদের।’ সাবধান করে করিম চাচা।

চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। দু’হাত দূরও নজরে আসে না। ভাগ্যিস জোনাক পোকাগুলো ছিল। ‘না হলি পথ হাঁটাই মুশকিল হয়ে যেত’ —ভাবে নূর। ঝিঁঝি পোকার ডাক কানকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। অন্য কোন আওয়াজ কানে পৌঁছানো যেন দিনের আলোয় চাঁদকে উজ্জ্বল হয়ে নজরে পড়ার মতো। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক যে এত তীক্ষ্ণ হতে পারে, নূর কখনো ভাবেনি। নূরের মাথাটা ঘুরতে থাকে। ফুল না ছোঁয়ালে পটল হবে না। পটল না হলি মিলনের পড়া...’ ভাবতে পারেনা। এখন অমাবস্যার গভীর অন্ধকার আর জোনাক পোকাগুলোই তার একমাত্র ভরসা।

সপ্তাহ না ঘুরতেই পটলের ফলন পড়ে গেল। সকলের মাথায় হাত। নূরেরও। সবাই ভাবে, পাপের ভারে এই দুর্দশা। প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। মাওলানা ডেকে খতম দেওয়া হলো। কেউ দুই, কেউবা তিন খতম দিলো। মিলাদ হল তিন দিন ধরে। কিছুই হলো না। কেবল নূরের ফলনটা খানিকটা বেড়ে গেল। 
‘কী করে হল?’ সবারই মনে একই প্রশ্ন। 
নুর বলল, ‘আল্লাহ পরোয়ারদেগার, তিনিই সব জানেন।’
জামাল নাকি দেখেছে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার রাতে নূরের পটল ক্ষেতে একটা উজ্জ্বল আলো ঘোরাফেরা করে। 
—‘ঠিক ফেরেশতারা আসে।’ তালবেলেম বলে ওঠে, ‘ওরা নূরের তৈরি। ওদের শরীল থেকে জ্যোতি বেইরে আসে। আমার মনে হয়, তার আলোই চোখে পড়তেছ।’ তালবেলেমের ব্যাখ্যায় সকলের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 
—নূর মুখ টিপে হাসে। 
জামাল ভাবে, ফেরেশতারা বেছে বেছে নূরের খেতে আসে? আর কারও না! করিম চা’ও বাদ? জামাল গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে হাঁটতে থাকে। সঙ্গে একমাত্র সঙ্গী জোনাকির আলো। নূরের খেতের যত কাছে পৌঁছাচ্ছে, জামালের বুকের ধড়ফরানিটা বেড়ে যাচ্ছে। ক্ষেতের মাঝ-বরাবর এক জায়গায় অন্ধকারটা যেন বেশ গভীর হয়ে আছে। উজ্জ্বল আলোটাও কখন যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। জামাল খেয়াল করেনি। ‘রহস্যটা জানতিই হবে’, ভাবে জামাল। গাঢ় অন্ধকারকে লক্ষ্য করে এগোতে থাকে সে।
‘ও মাগো!’ পটল গাছের লতায় পায়ের বুড়ো আঙুল আঁটকে যায় জামালের। মুখ থুবড়ে পড়ে যায় পটলের পিলির ওপর। মুখ উঁচু করে দেখে, গাঁঢ় গোলাকার অন্ধকারটা আস্তে আস্তে মাটি থেকে উপর বরাবর লম্বা হয়ে গেল। এই কি ফেরেশতা! ভয়ে ফেরেশতার দেহ থেকে নূরের জ্যোতি বেরোনোর কথাটা বেমালুম ভুলে গেল জামাল। মুখ থেকে আড়ষ্ট কন্ঠে বেরিয়ে এলো, ‘হু..হুজুর, আপনি কি ফে...ফে...ফেরেশতা?’
অন্ধকারের ভেতর থেকে বের হয় একটা চোখ-আধার করা তীব্র উজ্জ্বল আলো। ঠিকরে আসে জামালের চোখে। মুহূর্তেই গম্ভীর কন্ঠের গায়েবী আওয়াজ ভেসে আসে যেন। জামাল স্পষ্ট শুনতে পায়, ‘আমি নূরে-র-র জ্যোতি!’ জ্ঞান হারানোর সময় জামালের মনে হল এ নির্ভেজাল ঐশী বাণী। ফেরেশতার মুখ থেকে বেইরে এসেছে। জ্ঞান ফিরতেই, জামাল এক দৌড়ে বাড়ির উঠানে পৌঁছায়। মুহূর্তে জনমানুষে ভরে ওঠে তার উঠোন। নূর নানা মুখে ‘নূরের জ্যোতি’র নানান মহিমার কথা শুনতে শুনতে ভাবে, ট্রেন থেকে পাঁচ টাকায় কেনা পেন-লাইট আর বউয়ের কালো বোরখার কী মহিমা! এরা না থাকলি কি ‘নূরের জ্যোতি’র দেখা পেতো জামাল! নূর কি পেত, ক্ষেত ভরা পটল?
------------xx-----------




Saturday, March 07, 2009
11:20:42 AM
Ali Hossain
H/O : Asraf Ali Nasker
Brahmapur, Battala Bazar
( Near Post Office )
Kolkata-7000 96
Phone: 9432983876


মন্তব্যসমূহ

রচনাকাল অনুযায়ী গল্প : পড়ুন 👉 এখানে ক্লিক করে

আলী হোসেনের জনপ্রিয় গল্পগুলো পড়ুন

খোঁজ : প্রথম পাতা

গল্প : খোঁজ - আলী হোসেন। প্রথম পাতা ( গল্প সংকলন : দ্বিতীয় পিতা ) শুরু থেকে পড়ছেন আগের পাতা                         গল্প সংকলন                       দ্বিতীয় পাতা কীবোর্ডে স্ট্রোকের আওয়াজ। খট্-খট্‌, খট্, খট্-খট্-খট্, খট্-খট্,....। এত জোর যেন কান-মাথা ধরে যায়।! দশ-দশটি কীবোর্ড। চলছে এক সাথে। মাথার সাধ্য কি, না ধরে যায়!। এর মধ্যে ঋদ্ধির স্টোকের জোর, একটু বেশিই। বিগত দশ বছর ধরে চলছে এই কী-আঙ্গুলের ঠোকাঠুকি। তাই গা-সহা হয়ে গেছে সব। ক্রমে গভীর হয়েছে হৃদ্যতা, ঋদ্ধির সাথে কীগুলোর। কিন্তু পাশের জনের সহ্য হবে কেন? হ্যালো, শুনছেন? ঋদ্ধি বুঝতে পারেন, ওকেই উদ্দেশ্য করা হচ্ছে। একটু আস্তে স্ট্রোক দিন না! বাঁ পাশের সিটে বসা ছিপছিপে মেয়েটা বিরক্ত হয়। কীবোর্ডের খট খট আওয়াজ মাইক্রোফোন যেন লুফে নিচ্ছে। তাই সাথির কথার চেয়ে ওটাই বেশি পাচ্ছে পিউ। পিউ সাথির চ্যাট-ফ্রেন্ড। ভয়েজ চ্যাটেই ওরা বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আস্তে স্ট্রোক দেওয়ার চেষ্টা বরাবরই করে ঋদ্ধিনাথ। কিন্ত...

দ্বিতীয় পিতা

দ্বিতীয় পিতা লিখেছেন : আলী হোসেন  সকাল বেলা উঠেই চোখ দু’টো ডলতে থাকে মিরাজ। দুই হাতের মুষ্টি দু’চোখের পল্লবের উপর রেখে কব্জির মোচড়ে ডলা যা্রে বলে। বিরামহীনভাবে। মুহূর্তেই অক্ষিগোলক দুটো লাল হয়ে ওঠে, যেন জবাফুল। সঙ্গে ফুঁপিয়ে কান্না। আজ সে কোন মতে মাঠে যাবে না। গরু চরাতে ওর মোটেও ভালো লাগে না। ওর ইচ্ছা, বড় হয়ে স্কুল মাস্টার হবে। সেজন্যে যে অনেক লেখাপড়া শিখতে হবে! অথচ মা, তাকে গরু নিয়ে মাঠে পাঠাচ্ছে। বুকের ভেতরটা ভারি হয়ে আসে। মনের কষ্টে দম বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা। বুকের ভেতরের চাপটা বাড়তে থাকে ক্রমশঃ। বাড়তে বাড়তে এক সময় কষ্টের মেঘ আষাঢ়ে বৃষ্টির মত কান্না হয়ে ভেঙে পড়ে। খুব করে কাঁদতে পারলেই যে বুকটা আবার মেঘমুক্ত আকাশের মত হাল্কা হয়ে যায়, কিছু সময় গলা ছেড়ে কাঁদার পর মিরাজ তা বেশ অনুধাবন করে। ছোড়ার শক দ্যাকো, মাস্টার হবে! বলি, তোর বাপ কোনো দিন ইস্কুলির মুক দেকেলো। গরু চরানো পাচুনটা ছেলের দিকে বাড়িয়ে ধরে আচিয়া, ‘যা, গরু গুলোন চইরে আন, কাজ দেবেনি। ছেলের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, ‘কাঁচা ঘাস পেটে পড়লি গাইটার দুধ বাড়বে; এক কিলোর জাগায় দু’কিলো হবে, ইসকুলি গেলি কী বাড়বে শুনি’? কথাগুলো এখনও কানে...