সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

টান

ফুল থেকে নাড়ি ছিড়ে কোলে দিতেই ফুলির বুকের ভিতর কিসের যেন ছোঁয়া লাগে। আতুরের বিকট গন্ধ খোলস পালটে নাকের ডোগায় ভুরভুর করে ওঠে। অথচ এক বছর আগেও এই গন্ধ তার সহ্য হত না। ‘ওয়াক থু’... ওয়াক তুলতে তুলতে ছুটে পালাত ফুলি। পেট ভরা থাকলে তো কথাই নেই। হড়হড় করে বমি তুলে দিত। ফুলি নিজেই ভেবে পায় না, এমন কি করে হয়! কোনে টানে।

কিন্তু হয়। চেষ্টা করলে সব হয়। কথায় বলে শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়। হলও তাই। সহ্যও হল সাধ পুরণও হল। সেবার ওপর ওয়ালার কাছে খুব কেঁদেছিল ফুলি। ‘আল্লা, আমার এট্টা ছেলি দিও। এক মজ্জিদ লোক খাতি দোবো’। আল্লা শুনেছে। ‘পেত্তমডা ছেলি হলি, পরেড্ডায় আর চিন্তা থাকে না’। তাই এই মানোত।

‘এই মাগি, ভালো করে দ্যাক। কী বিয়ুলি’। দুই ঠ্যাং ফাঁক করে বাচ্চাটাকে ফুলির সামনে উঁচু করে ধরে দাই মা। দু’শ টাকা বকশিস না দিলি ছাড়চি নি, এই বলি দিলুম। হটে বেগুনির গায় আগুন নেগিচে। দু’নো দাম হয়িচে সব জিনিসির। আনাচ-পাতিতি তো হাত দিবার মোতো নি। রসিক জনের মত ভ্রু দুটো কপালে টেনে ধরে। পেন্ডুলামের মত মাথা দুলিয়ে বলে, এখন আর একশ টাকায় হবি নি’।

দরদর করে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মত একরাশ উৎকণ্ঠা আর অস্বস্তি উবে যায়। সমস্ত শরীর ও মন তুলোর মত হালকা হয়ে যায় ফুলির। হাত বাড়িয়ে ছেলেকে বুকে নিতেই আনন্দ বাঁধ ভাঙে। মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, মানিক আমার ... সোনা আমার...।

সেই থেকে সোনাই ওর সব। ধ্যানে-জ্ঞানে, শয়নে-স্বপনে সোনাই অরফে সোনা-ই তার সোনারতরি। এখন চুলোর আগুনে আমপাতা পোড়ার পটপট শব্দেও শুনতে পায় সোনাই-এর থপথপ হেঁটে চলার শব্দ। গভীর রাতে হুঁলো বেড়ালের ডাকেও চমকে ওঠে ফুলি। ভাবে সোনাই বুঝি কেঁদে উঠল! ঘুমের মধ্যেই পুরুষ্ট স্তনের বোঁটা মুখের মধ্যে পুরে দেয়। চকচক শব্দে টানতে থাকে সোনাই। অথবা সোনাইয়ের সাড়া না পেয়ে তড়িঘড়ি চোখ ম্যালে। অস্থির চোখে দেখে, ঘুমে কাদা হয়ে শুয়ে আছে তার বুকের ধন। আসলে ফুলি এখন সোনায় সোহাগি। সোনাই-এ মজে আছে সারাদিন সারারাত।

সেই সোনাই এখন কথা শোনে না। যখন ক্লাস থ্রিতি পড়ে, তখন থেকেই শুরু। কোনদিন স্কুলে যায়। কোনদিন যায় না। গেলেও সময় মত বাড়ি ফেরে না। জিজ্ঞাসা করলে উত্তরও দেয় না সবসময়। কোথায় যায় কি করে, কিছুই বলে না। ‘মনি হয় রিপনই ওর মাতা খাচ্চে। রোজ ওর সাথে বেরুচ্চে আর রাত করি ফিচ্চে। চিন্তায় পড়ে ফুলি। ওর মা’ডা তো রোজ শওরে যায়। বলে পরের বাড়ি কাজ করি। লোকে বলাবলি করে...। কি জানি, কাজ করে না অন্য কিচু করে। দেকতি শুনতি যা, তাতি...। তবে এ নিয়ে ফুলির মাথাব্যাথা নেই। ওর চিন্তা সোনাত কে নিয়ে। রিপনের সঙ্গ ছাড়াবে কি করে! চিন্তায় কপালের ভাঁজ দীর্ঘ হতে থাকে ফুলির। বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্মৃতির রং-চটা পাতা ওল্টায় সে। মনটা হালকা করার জন্য।

কি রে , ছেলি পেয়ে তো বরডারেই পর করে দিলি। ছেলিডা পালি যার জন্যি, তার দিকি এট্টু নজর দে।

ফুলি কথা বলে না।

বলি, ছেলিডা দেলি কে তোর?

কে আবার, আল্লা দিচে। আল্লার কাছে কেঁদিচি, আল্লা দিচে।

আল্লাই দিচে। সত্যি কতা। কিন্তু মাদ্যমটা কে? আমি তো?

তাতি কি?

কি আর। ভোমোরের সোহাগ খেলি। তার রক্ত পেটি ধরলি। আর যার জন্যি পোয়াতি হলি, তারিই ভুলি গেলি।

ফুলি পাশ ফেরে, ফকিরের মুখোমুখি হয়। সঙ্গে চকাশ করে শব্দ ওঠে। ভরাট দুধের বোঁটা ফসকানো শব্দ। সোনাইয়ের মুখ থেকে গুলতির মত বোঁটাটি বেরিয়ে যায় ফুলির খোলা বুকে। ধরফড় করে ঠেলে ওঠে সোনাই। মায়ের গলা জড়িয়ে টানতে থাকে। ফুলি আবার সোনামুখি হয়।

না মশাই, ছেলির মুখ তোমার জন্যি না, আমার জন্যিই দেকিচি। বুজলে?

তার মানি?

মানি মানকচু। মুখ ভাঙায় ফুলি। তোমার মনে নি? তুমি বললে ছেলি দিতি হবে। চিড়েগুড়ির দিদিমনি বোললো, ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা তো তোমার উপর নির্ভর করে। আবডালে এসি তুমি কী বললে, মেয়েনোক মেয়েনোকের ছাপাই গাচ্চে। একন উলটে শুলি হবে?

কথায় হারিয়ে ফুলির বুকের ভেতরটা সেদিন মুক্তো বাতাসে ভরে উঠেছিল। জীবনের মানেটাই পালটে গিয়েছিল তার।

আজ আর-একবার পাল্টাতে চলেছে তার জীবনের মানে। ফুলি যানে না। তবে শরীরটা যে তার ভালো যাচ্ছে না, এটা বোঝে। সোনাই লক্ষ্য করেছে মায়ের মনটা আগের মত নেই। সব সময় খিটখিট করে। আগের মত ভালোওবাসে না তাকে।

এত সময় ক’নে ছিলি? স্কুল কি এখন ছুটি হল তোর?

সোনাই মুখ নিচু করে।

আমি বিচানায় পড়ার পর, এই তিন বচর ধরি তুই আমারে জ্বালাচ্চিস। আমার কি এট্টু নিশ্চিন্তে মত্তি দিবি নি! কি রে কতা বলিস নি ক্যান? কোতায় যাস, কি করিস। বল না শিগগির। ধৈর্য্য হারায় ফুলি। ঠাস করে চড় কষায়। চার আঙুলের দাগ বসে যায় চোয়ালে। বাঁ-হাতেই বাঁগালে হাত বোলায় সোনাই।

সোনাই-এর খুব কষ্ট হয়। শরীরে যেমন, তেমন মনেও। আজকাল কথায় কথায় মা তাকে বকে। কখনো মারেও। একটুও ভালোবাসে না যেন। ক্ষোভে হাতের পাঁচ আঙুল গুটিয়ে যায় নাড়া-খাওয়া কেন্নোর মত, সব ওই শয়তানটা জন্যি। কোন দিন গলা টিপি মেরি ফ্যালবো। একে বারে পেচন পেচন চলি এয়েচে। হিংসুটি কোতাগার। গলা উচিয়ে বলার সাহস নেই, তাই মনে মনে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, কেন সোনার চেয়ি কি মানিকির দাম বেশি, যার জন্যি আমাকে ভুলিই গেলি। মেয়ের চোখে চোখ রাখে সোনাই। বলতে চায়, তোকে এত ভালোবাসি, তুই কি দেখতি পাস নে? বুকের ভেতর ডুকরে ওঠে কান্না।

ফকিরেরও তাই মনে হয়। ফুলিডা যে ভুলেই গেছে বরকে। ভালোবেসে বিয়ে তাদের। পাড়ার লোকে অবশ্য বলে ‘নাইন’ ক’রে। একবছর না যেতেই সোনাই এলো। তার পর বছর না ঘুরতেই মানিক। সোনাই হলি তো বউডা বোন হয়ি গেল। ভাতারডা পাশে পড়ি থাকে। শালি যেন দেকতিই পায় না। মানিক হলি বিচানাটাই আলাদা করি দেলো। মাঝে মাঝে মাথায় আগুন ধরে যায় ফকিরের। বিয়ের পেত্তম মাসেই পেট বাদালি। বললুম দাক্তারের কাছে যাস নি। শুললে মোর কতা। কেন, আমরা কি হই নি? আমার মা দাক্তার খানায় গেলো নাকি কোনো দিন। যতসব ধান্দাবাজির দুনিয়া। শালারা দাক্তার সেজি গরিব মানষির ঠকায়। বলে কিনা, পেত্তম তিন মাস আর শেষির তিন মাস মিলামিশা যাবে নি। কেন? কোন শাস্ত্রে নেকা আছে শুনি? ভয়ে বউডা কাচে আসাই ছেড়ি দ্যালো! আমি যেন শালা বিজ পোতা মালি। জো উঠলি বিজ পোতো আরা সারা বচর পাহারা দ্যেও।

ফকির, বাড়ি আচিস? কানাই আধ-ময়লা গামছাটা ডান হাত উল্টে কাঁধে ফেলে। দু’ভাজ করা গামছার মাঝ-বরাবর ধরে মাছি তাড়ানোর মত করে বলে, আমি রুতি যাচ্ছি। বিকালে পতসবা আচে। যাতি হবে কিন্তুক।

কানাই সারা বছর জোন খাটে। কিন্তু পার্টি অন্ত-প্রাণ। পাড়ায় দাপট ও খুব। ওর কতা অমান্যি কত্তি বুকের পাটা নাগে। ফকির মাথা নেড়ে বলে, ঠিক আছে কানাইদা। কিন্তু কার কথা রাখবে ফকির। ভোর বেলা শামিম বলে গেল পথ সভা আছে। ও ইদানিং নাকি দিদির কাছের মানুষ হয়েছে। কি যে করি না। ফকির গজ গজ করে ওঠে। বাবুরা মুন্ত্রি হবে আর আমাদ্র শালা মত্তি হবে। গরিবির রক্ত ছাড়া যেন ভোট হয় না।

আজকাল নেতাদের মোটেই সহ্য করতে পারে না ফকির। জিনিসের দাম হুহু করি বাড়তিচে। কারো কোন হুঁস আচে। নিজিরা চাকরি করতিচিস। মাইনেটাও দ্বিগুণ করি নিলি। আমাদের কি হবে একবার ভাবলি নি। বাজারে তো কিছু কেনার জো নি, তোদের জন্যি। বাজার বসার আগেই ব্যাগ ভরতিচিস।পয়সার জোর হয়েচে না। ঠোঁট বিচরে বিদ্রুপ করে, মোড়ে মোড়ে পতো-সবা ক’চ্চে। দেখি শালা পিত্তি জ্বলি যায়।

এবার আর বউ-এর কথা শোনে নি ফকির। দাক্তার বাড়ি যেতি হলি বাপের বাড়ি থেকি টাকা আনবি। আমি দিতি পারব না। ঘুমন্ত পৌরুষ খোঁচা দিয়ে জাগায় ফকির। এবাই তাই ডাক্তারের কাছে যায় নি ফুলি। অভিমান করে। ফকিরও পাত্তা দেয় নি।

সোনাই মায়ের কাছে শুনেছে, মা এবার মত্তি মত্তি বেঁচি গেচে। বেঁচে গেছে ঠিক। কিন্তু সেই বাঁচাই কাল হয়েছে তার।

সন্তানের নাড়িতে নাকি টিউমার হয়েছে। সন্তানের সাথে সাথে সেও বেড়ে গেছে। পেটটা দিনদিন ফুলে উঠেছে জোড়া পোয়াতির মত। শেষে সন্তানটা তো বাঁচলোও না, উল্টে টিউমার ফেটে ফুলির যায় যায় অবস্থা। ফুলি ভাবে এর চেয়ে মরি যাওয়াই ভালো ছেলো।

মায়ের দুঃখে ককিয়ে ওঠে সোনাই-এর বুক। অপারেশন করতে হবে। কিন্তু টাকা কোথায়! ওর বাবা বলে, ধরমপুর থাকে হাবড়া ভাড়া আট টাকা ছেলো, আট টাকাই আচে। অতচ আট টাকার আলু ষোল টাকা হয়ি গেচে। তার ওপর অটো অলাদের জ্বালায় তো ভাড়াই হয় না। কী কি অটো ছেড়ে রিকশা ভ্যানে ওটে। কি করি বাঁচি বলদিন বাপ। তোর মাকেই বা বাঁচাই কেমন করি। খুব কষ্ট হয় সোনার। কষ্ট হয় নিজের জন্য, নিজের ভাগ্যের জন্যও। কষ্টের মধ্যেই মাথায় ঢোকে অদ্ভুত সব ভাবনা।

আব্বু, আল্লার কি একচোক কানা?

তোবা তোবা, এরাম বলতি নি বাপ। আল্লা পাপ দেবি।

কেন?

আল্লা নিরাকার। তার তো মানষির মত দেহ, চোক, কান এসব কিচ্চু নেই। তাই কানা হবে কি করে?

তালি দুনিয়ার কেউ বড়লোক কেউ গরিপ কেন?

এত সব বলতি পারিনে বাপ। ছোটো কালে আব্বার কাচে শুনিচি, আব্বার আব্বা নাকি বোলতো ইংরেজরা চলি গেলি দুক্কুও চলি যাবে। আব্বাকে জিজ্ঞেস কোত্তো, দেকদিন বাপ, দুক্কু কি চলি গেচে? তারপর আব্বা চলি গেল। আমার দেহে তকন নতুন যৌবোন। হ্যায়চা মালো ধান হো... বলতি বলতি গ্রাম ছেঁইয়ে ফেললুম নাল পতাকায়। আমি স্বপ্ন দেকলুম, দেশি আর গরিপ থাকবে নি।তাও কি হয়েচে? একন আবার অন্য কতা শুনচি। কোন কতাডা সত্যি বলদিন বাপ। ফকির ভালোই জানে এর উত্তর ছেলে জানে না। তবু একদমে একশ পাতার ইতিহাস পড়ে দম নেয় ফকির। দুনিয়ার মানষির মতিগতিই যকন বিজতি পারি নে, তকন আল্লার খেয়াল বোজবো কি করি।

তালি মা’ডা এমনি এমনি মরি যাবে?

জানি নি। ফকিরের চোখের কোন ভিজে যায়। পড়ন্ত বেক্লার নিভন্ত আলো ঠিকরে পড়ে চোখের কোনে। দূর্বার ডগায় নেহরের বিন্দুর মত চকচক করে ওঠে।

আল্লা যা কপালে রেখিচে তাই হবে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে শব্দ করে।

আমরা কিচু করতি পারি নে আব্বু? তেরো বছরের সোনাই প্রশ্ন করে। সোনাই জানে এর উত্তরও হবে, জানিনি বাপ। তাই এই প্রশ্ন বাতাসেই ভাষিয়ে দেয় সোনাই। সোনাই শুনেছে আগে তার বাবা পার্টির হোলটাইমার ছিল, আর এখন দেখছে তবলিক-অন্ত প্রাণ।

মার জন্যি কিছু একটা করতিই হবে। প্রতিজ্ঞা করে সোনাই। ইংলিশ প্যান্টের রঙটা চটে গেছে। মাটি আর পাছায় ঘষা খেয়ে ঝেঁজির পাখার মত পাতলা হয়ে গেছে পিছনটা। প্যান্টায় পা গলিয়ে কোমরে তোলে সোনাই। ছিঁড়ে ধুকড়ি হয়ে যাওয়া ব্যাগটা ঝপ করে কাঁধে ফেলে দুহাতে। তারপর দ্রুত স্কুলের পথে হাঁটতে থাকে।

সোনাই এবছর ক্লাস সেভেনে পড়ছে। রিপনও। রিপন সোনাই-এর বন্ধু। ক্লাস ওয়াল থেকে। রিপনের বাবা নেই। মা তো থেকেও নেই। নিশ্চিন্তে পরের বাড়ি কাজ করার জন্যে রিপনকে স্কুলে পাঠায় ওর মা। যায় ভোরে, ফেরে রাতে। রিপন ভাবে সোনাই ভাগ্যবান। ভগবান তুমি যেন ওর মাকে তুলি নিও না। নাচন দিদিমনি সর্বশিক্ষা মিশনে কাজ করে। স্কুলে না গেলে সেও তাড়িয়ে বেড়ায়। অগত্যা স্কুলে যাওয়া। তবে তার কিছু পিছুটান নেই। নেই বাড়ি যাওয়ার তাড়াও। তাই স্কুল থেকেই বেরিয়ে পড়ে দু’জন। গত তিন বছর এভাবেই বেরিয়ে যায়। বাড়ি ফেরে সন্ধ্যায়। কোন কোন দিন রাতও করে। আজ সারারাত বাড়ি ফেরেনি সোনাই। রাতচরা পাখির মত জেগে থাকে ফুলি।

কে ও! সোনাই না? হ্যাঁ, সোনাই-ই তো। প্রশ্ন ও উত্তর একই সঙ্গে বেরিয়ে আসে আশিসের জিভ বেয়ে। আশিস সোনাইদের শিক্ষক। কামার থুবার নাথ পাড়ায় বাড়ি।

তুই এখানে? কি করছিস? আসলে কথা শুরু করার জন্যই প্রশ্ন। কারণ, আশিস স্যার দেখেছেন সোনাই কি করছে। সোনাইয়ের ডান হাত থেকে একটা সুতো ঝুলছে মাটির সঙ্গে সমকোনে। সুতোর মাথায় কি একটা বাঁধা। বেশ ভারি মনে হচ্ছে। মাছ ধরা ছিপের মত থুপিয়ে চলেছে সেটা। পুকুরে বেলে মাছ ধরার মত। স্যারের গলা শুনেই চমকে ওঠে সোনাই। যেন ভূত দেখে। তড়িঘড়ি সুতো গুটিয়ে ভোগলির ভেতর পোরে। আশিস স্যারের মনে পড়ে ছোটো বেলা ভোগলি নিয়ে আম কোড়ালোর কথা। পাটের বিজ ভর্তি কাপরের থলি, খালি হলে বলে ভোগলি। ঝড়ের সময় বা কাকভোরে এই ভোগলি নিয়ে কত আম কুড়িছে আশিস। সে সব এখন স্বপ্ন।

কিন্তু এখন আম পাকা ফাগুনও নয়, ধারে-কাছে আম গাছও নেই। এমন কি পুকুরও। এটা চোংদা মোড়ের রামমল্লিকের মোটর গ্যারেজ। এখানে ও কি করছে? সামনের প্রশস্ত জায়গায় হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে সোনাই।

কি হল , বললি না তো?

সোনাই উত্তর দেয় না।

চোখমুখ তো শুকিয়ে গেছে। আমার সাথে বাড়ি চল। ধমক দেয় আশিস স্যার।

আমার মা শরিল খারাপ। আমি লোহা কুরুচ্চি।

মানে? আশিস স্যার অবাক হয়।

ভোগলি থেকে একমুঠো নাট-বল্টু আর বিয়ারিংয়ের বল বের করে সোনাই। সঙ্গে কিছু বিভিন্ন মূল্যের কয়েন। কোনটা চারআনা, কোনটা আটআনা...। আজ এগুলোই কুড়িয়েছে। আর আছে সুতোয় বাঁধা একখন্ড চুম্বক। সোনাই বলে চোমক। চোমকের টানে কখনও নাট, কখনও বল্টু, আবার কখনও কারও হারিয়ে যাওয়া কয়েন চলে আসে সোনাইয়ের হাতে। এগুলি বিক্রি করে সে টাকা জমায়। মায়ের অপারেশন করাবে। আশিস স্যার আরও একবার অবাক হয়।

হঠাৎ রিপন হাজির হয়। এপর্যন্ত তার দু’হাজার জমেছে। সোনাইকে দেওয়ার জন্য ভোগলি শুদ্ধ হাত বাড়ায় রিপন। বন্ধুর মায়ের জন্য সেও দু’বছর ধরে সুতোয় বাঁধা চোমক নিয়ে ঘুরছে। কখনও সাইকেল-ভ্যান-রিকশা সারাইয়ের বন্ধ দোকানের সামনে, কখনও বন্ধ মোটর গ্যারেজের সামনে। আবার কখনও...।

আশিস স্যার তৃতীয়বার অবাক হয়। সোনাইওয়ের টান বুঝি, কিন্তু রিপন ঘোরে কোন চোমকের টানে।

ÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅáááááááááááááÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅÅ

1805 words

Saturday, July 25, 2009

1:26:42 AM

Ali Hossain

H/O : Asraf Ali Nasker

Brahmapur, Battala Bazar

( Near Post Office )

Kolkata-7000 96

Phone :  9432983876

আজ বিকাশে প্রকাশিত

মন্তব্যসমূহ

রচনাকাল অনুযায়ী গল্প : পড়ুন 👉 এখানে ক্লিক করে

আলী হোসেনের জনপ্রিয় গল্পগুলো পড়ুন

নূরের জ্যোতি

কেমনে রাখবো কুল / পটল গাছে হয়না পটল /  না ছোঁয়ালে ফুল -- সুর করে  গান গাই গল্পটির ইউনিকোড ফন্টে খুব শিঘ্রি প্রকাশিত হবে। অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। Saturday, March 07, 2009 11:20:42 AM Ali Hossain H/O : Asraf Ali Nasker Brahmapur, Battala Bazar ( Near Post Office ) Kolkata-7000 96 Phone: 9432983876

জলপট্টি

আলী হোসেনের ছোটগল্প - জলপট্টি সেদিনের কথাগুলো ভাবতে বসলে মায়ার চোখ দুটো ভিজে যায়। সবে সুখের মুখ দেখেছে ওরা। প্রচণ্ড দুর্দিনেও যারা মাটির টানকে উপেক্ষা করতে পারে নি, অসময়টা যখন কাটতে চলেছে, ঠিক তখনই শিকড়টা গেল কেটে। যেন প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস থেমে যাওয়ার মুখেই  লাটাই থেকে সুতটা ছিড়ে গেল। সুত-কাটা ঘুড়ির মত পাক খেতে খেতে দশ-পুরুষের ভিটে ছেড়ে এসে পড়ল কলকাতায়; কংক্রিটের জঙ্গলে। যারা ভরসা দিল, ‘পথের শেষ কোথায়’ দেখাবে, তারা কেমন সরে গেল সেই পথেই কাটা রেখে। পরেশের কথায়, ‘না রিফিউজি হলাম, না পেলাম নিজের জমি-জিরেত বিকিয়ে কেনা জমির দখল’। তাই চোখের কোন থেকে জলের ক্ষরণ কমে গেলেও বুকের ভেতরের গভীর ক্ষত এখনও শুকোয়নি মায়ার। তবে এ ক্ষতে সুস্থতার প্রলেপ পড়েছিল একবার। নয় নয় করে সেও বছর পনের আগের কথা। পরেশ তখন ফুটপাতের সব্জিওয়ালা, রতন ক্লাস ফোর-এ। ‘একখান কথা কইবো’? পরেশ চোখ তোলে। চোখে চোখ রেখে ঘাড় নাড়ে; তার মানে, ‘বলুন’। ‘আপনে কি নতুন বাংলাদেশ থিকা আইছেন’? পরেশ এবারও ঘাড় নাড়ে, মানে, ‘হ্যাঁ’। তোমার লগে কতা কইয়া, চাল-চলন দেইখ্যা তো লেহাপড়া জানা মনে অইতাছে। আজ্ঞে, ইন্টারমিডিয়েট পাস। চাকরি কোরবা? পরেশ...

খোঁজ : চতুর্থ পাতা

গল্প : খোঁজ - আলী হোসেন। চতুর্থ পাতা ( গল্প সংকলন : দ্বিতীয় পিতা ) শুরু থেকে পড়ুন আগের পাতা                          গল্প সংকলন                       পঞ্চম পাতা ঋষিতা আজ নেই। সশরীরে। কিন্তু সে তার জীবন থেকে একেবারে বিচ্ছন্ন হয়ে যায় নি। হয় নি, তা আরও একবার প্রমান হয়ে গেল। আজ। আজও সে হেরে গিয়ে জিতে এসেছে। সে চাইলেই বিট্টুকে সপাটে একটা ঘুষি চালিয়ে দিতে পারতো। নিদেনপক্ষে একটা চড়ও। সে সামর্থও তার আছে। কিন্তু তারপর? বিট্টুরা কিভাবে রিয়্যাক্ট করত! এখন ভাবতেই শিউরে ওঠে শরীর। মধ্য-পঞ্চাশের ঋদ্ধিনাথ। পাঁচ বছর হল ঋষিতাও গত হয়েছে। ঈশিতা তো থেকেও নেই। তাই কোন পিছুটান তো তার ছিল না। তবু পারে নি। আর এতেই কি প্রমান হল না ঝগড়া নেই মানে ঋষিতা নেই, এও সম্ভব। ঋষিতার মূল্যায়ন এভাবেই করে এখন। ভাবে, জীবনের ধর্মও জলের মত। যে পাত্রে যায়, তার আকার ধরে। সময়-পাত্রে এক সময় সবই সয়ে যায়। ঈশিতাকে হারিয়ে যে শুন্যতা, তাও এক সময় সয়ে গিয়েছিল।  ভরে দিয়েছিল ঋষিতাই। কিন্তু বাইপাসের...