সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আদুরী

আদুরী

লিখেছেন আলী হোসেন

আলপথ। সাবধানে পা ফেলছে ইসলাম। যথাসম্ভব দ্রুত পায়ে। দুপুরের আযান শেষ হয়েছে একটু আগে ই। আজান মানেই ছুটির ঘন্টা। পেটের নাড়িতে টান। তাই ঘরে ফেরার তাড়া। পথের দু'পাশের জমিতে সরিষা গাছের ফুল এসেছে। যেন পটে আঁকা ছবির মতো দেখাচ্ছে দু’পাশটা। মৌমাছির আনাগোনাও বেড়েছে তাই। মৌমাছির আলিঙ্গনে সরিষা ফুলের গভীর নিঃশ্বাসে শব্দ শুনতে পায় ইসলাম। রঙ ধরে মনে। ইচ্ছা করে দু'দণ্ড দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু মনটা যে পড়ে রয়েছে বাড়িতে। দু'বছরের মেয়েটা যা পাকা হয়েছে না! চলতে চলতে হেসে ওঠে ইসলাম - ‘যেমন মা তার তেমন মেয়ে’।

উঠানে পা দিতেই নজর পড়ে মামণির দিকে। দুই হাত মাথা'র উপর তুলে ছুটে আসছে। বেসামাল পা, শুদ্ধ ওঠা দুটো দুটো চারটি দাঁত। উপরে দুটো, নিচে দুটো। দুধ সাদা দাঁত বের করে ছুটছে আর পিছন দিকে তাকাচ্ছে। মায়ের আগেই পৌঁছাবে সে। উঠানেই বসে পড়ে ইসলাম। সমস্ত গায়ে বিকেলে বিলের পচা মাটির গন্ধ। পরোয়া নেই তাতে। দুইহতে গলা জড়িয়ে বলে, “আব্বু, তুমি থুদু আমাল আদল কলবে, আম্মুকে না। কাল লাতে, থুদু আম্মুকে আদল কলেচো।”

মেয়ের কথায় লজ্জা পায় আদুরী। চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে। এক ছুটে ঘরে চলে যায়। ইসলাম খুব করে আদর করে মেয়েকে। কথা দেয় এবার থেকে মাকে নয় শুধু তাকেই আদর করবে। গলা ছেড়ে খেলতে শুরু করে মামনি। ইসলাম উপলব্ধি করে, মেয়ে বড় হচ্ছে।

পা টিপে ঘরে ঢুকে ইসলাম। আদুরীর মুখ ভার - ‘তুমি মেয়েকে ওরাম কথা দিলে কেন?’
আসলে মুখভার করাটা বাহানা। ইসলাম ও বোঝে। তাতানোর জন্য বলে - ‘কথায় বলে না মেয়েরা এক বিয়োনেই এই বুড়ি। তাই তোমার পতি আমার আর কোন ইন্টারেস্ নেই’ বলেই ঘর থেকে বেরোনোর ভান করে ইসলাম।
‘যাচ্ছো যে!’ পিছন থেকে লুঙ্গি টেনে ধরে আদুরী, মেয়েটা তো মেয়ে আদায় করেছে, আমারটা?
পিছন ফিরে কাছাকাছি হয় দুজনে।

বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আদুরী। ভালো জামাই চাই। তাই লেখাপড়া শিখিয়েছেন মেয়েকে। মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক। জামাই বিয়ে পাস হলে মানায়। নিদেনপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক না হলে হয় না। খুব খুঁজেছেন। টাকা দিয়ে ঘটকও লাগিয়েছেন।
আচ্ছা খবরের কাগজে দিলে হয় না?
দিলে তো হয়, কিন্তু.....
কালো রং কি কাগজে দিলে পরিস্কার হয় আদুরীর মা? মনে মনে ভাবে আদুরীর বাবা, দেখো, মুসলিম সমাজে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে লেখাপড়ার তেমন চল নেই। তার ওপর আদুরী কালো। কাগজের দিয়ে কি লাভ হবে?

সেই আদুরী আজ ইসলামের ঘরনী। ইসলাম প্রায় নিরক্ষর। প্রথম প্রথম কদিন খুব কেঁদেছিল আদুরী। মাঝে মাঝে জল ভরা চোখের ঝাপসা নজরে উঠে আসতো বাবার অস্পষ্ট ছবি। প্রচন্ড ক্ষোভ উগরে দিত, ‘লেখাপড়ায় তো আমি খারাপ ছিলাম না। আমাকে কেন আরো পড়তে দিলে না বাব। আমি নিশ্চয়ই নিজের পায়ে দাঁড়াতাম। আমার স্বপ্নকে তুমি এভাবে নষ্ট করলে কেন?

এখন সে আর কাঁদে না। সমাজ যে আজও মেয়েদের শৃংখল মুক্ত করে নি তা সে হারে হারে বুঝেছে। তাই তার আক্ষেপ, রামমোহন বিদ্যাসাগরের মতো কেউ কেন এলো না তাদের সমাজে। ইসলাম জানে, বুঝেও আদুরীর কষ্ট। তাই বউয়ের পরামর্শে সাক্ষরতার স্কুলে যায় সে। এখন খবরের কাগজ পড়তে পারে। বউয়ের কাছে ইংরেজি শব্দ শুনি বলার চেষ্টা করে। অন্যেরা মুখ টিপে হাসে। কেউ কেউ বলে বউ-পাগলা। ইসলাম ভাবে, বড়দের কথা শুনলে লোকে বউ-পাগলা বলে কেন? বউয়ের পরামর্শ নেয়ার মধ্যে অপৌরুষেরই বা কি আছে!

যে যাই বলুক, বউ কিন্তু আমায় সত্যিই ভালোবাসে - সান্ত্বনা খুঁজেন ইসলাম। তোর পতি, থুড়ি, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা তো শুধু ইস্টিরির পতি স্বামীর ভালবাসা নয়, মানুষের পতি মানুষের ভালোবাসাও বটে।

ইসলামের কথা শুনে অবাক হয়ে আদুরী। এসব কথা তুমি কিভাবে বুঝলে?
কেন? সাক্ষরতার ইস্কুলে। উত্তর দেয় ইসলাম। এই ভালোবাসাটা আছে বলেই তো আমরা মানুষ। নইলে তো বন্য হয়ে যেতুম। মাঝে মাঝে ভাবি, করা ঠিক, সুমন মাস্টার, না পতিবেশিরা?
নারী পুরুষ কখনো সমান হতি পারে না। তাই সমান অধিকার নয় নারী সব সময় পুরুষের শাসনে থাকবে।
আর সুমন ভাই?
সুমন মাস্টার বলে, বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। তাই নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকা উচিত। প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে প্রত্যেক মানুষের গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠা উচিত।
সুমন নয় এটা কবি নজরুলের কথা। আদুরী বলে সুমন ভাই-ই ঠিক।
ইসলাম বুকে বল পায়।

ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় চারটে। দক্ষিণমুখী ঘরের সামনে একটি প্রশস্ত উঠোন। উঠোনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অনেক পুরানো আমবাগান। পড়ন্ত বেলার রঙিন আলো পাতার ফাঁক দিয়ে উঠোনে পড়ছিল সার্চ লাইটের মত। সেই আলোয় ভিজে গা গরম করার চেষ্টা ইসলামের।
হাটে যাবে না? আদুরী ঘর থেকে জিজ্ঞাসা করে, আজ রোববার মনে আছে তো?
হ্যাঁ মনে আছে, বৈকালের ঠান্ডায় দাঁতে দাঁতে পোকা লাগে।  কন্ঠে কাঁপন অনুভূত হয়। সরে যাওয়া সূর্যের আলোর দিকে এগিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বলে আমার লাল সোয়েটারটা একটু আনো দিনি।
কেন ওটা আবার কি হবে?
গায়ে দেব।
কী রুচি তোমাদের! লাল রংটা আদুরীর মোটেও পছন্দ নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তুলে দেয় ইসলামের হাতে।
মানে?
মানে মান কচু। ক্যাটক্যাটে লাল সোয়েটার পড়ে বাজারে গেলে লোকে হ্যাংলা বলবে। বুঝলে?
হ্যাংলা বলবে? কেন!  অবাক হয় ইসলাম।
ঘাটে কি সে বুদ্ধি আছে যে বুঝবে? খোঁচা দেয় আদুরী। লেখাপড়ার পানি যদি পেটে থাকতো, বুঝতে।
মায়ের পছন্দ করা সোয়েটার। কছাট আমাকেই দেয়া হয়েছে বলে ভাবে ইসলাম। মুহূর্তে মাথা গরম হয়ে যায়।
এইজন্যেই লোকে বলে মেয়ে লোকদের মাথায় তুলতি নেই। ইসলাম হাতের বিড়িটায় শেষ টান দিয়ে আছাড় মারে। সপাটে গালে চড় মেরে বসে বউকে। খুব বারানি হয়েছে না। হাউ গিলতে গিলতে বাউ শুরু করেছিস।
আদুরী ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা।
অত রুচিটুচি বাপের বাড়ি গিয়ে দেখাবি বুঝলি?
আদুরী অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। দৃষ্টিতে উপেক্ষার আগুন। কোন শাব্দিক প্রতিবাদ নেই।
আরো তেতে ওঠে ইসলাম। ইতি আবার উনি নেকাপড়া জানা মেয়ে! মুরব্বিদের সম্মান দিয়ে কথা বলতে জানে না, সে আবার নাকি শিক্ষিত!
কোন ভাষায় প্রতিবাদ করবে আদুরী? ভেবে পায়না। করেই বা কি হবে। সেকি পারবে পাল্টা একটা চড় কষিয়ে দিতে? পারবেনা। কারণ ওই চড়টা সটান গিয়ে পড়বে সমাজের গালে। আদুরী জানে, সমাজের রোষ সামলানোর ক্ষমতা তার নেই। যতই লেখাপড়া শিখুক, স্কুল-কলেজ নারী স্বাধীনতার স্লোগানে মুখর হয়ে উঠুক, চলার পথ তাতে আলোকিত হয়নি আজও।

* লেখাটি আংশিক আপলোড হয়েছে।

প্রকাশিত হয় ঃ অনাহত মাসিক পত্রিকায়।
প্রকাশের তারিখ ঃ ২০/০৮/২০০৯

মন্তব্যসমূহ

রচনাকাল অনুযায়ী গল্প : পড়ুন 👉 এখানে ক্লিক করে

আলী হোসেনের জনপ্রিয় গল্পগুলো পড়ুন

নূরের জ্যোতি

কেমনে রাখবো কুল / পটল গাছে হয়না পটল /  না ছোঁয়ালে ফুল -- সুর করে  গান গাই গল্পটির ইউনিকোড ফন্টে খুব শিঘ্রি প্রকাশিত হবে। অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। Saturday, March 07, 2009 11:20:42 AM Ali Hossain H/O : Asraf Ali Nasker Brahmapur, Battala Bazar ( Near Post Office ) Kolkata-7000 96 Phone: 9432983876

মড়ক - আলী হোসেন

মড়ক আলী হোসেন      কোনটা সময় আর কোনটা অসময়, সময়টা চলে না গেলে যেন বোঝা যায় না। বলা ভালো, ঠিকঠাক বোঝা যায় না। বিজ্ঞজনেরা তো তা-ই বলে। রতন বিজ্ঞজনও নয়, সময়ের গলিঘোঁজ খুঁজে স্বাস্থ্য পরীক্ষাও তার কম্ম নয়। তবে তার সময় যে ভালো যাচ্ছে না, সে বিলক্ষণ জানে। জানে বলেই বোধ হয় বিষন্ন হয় মন, কখনও সখনও ভারিও। বিশেষ করে বাড়ির উল্টোদিকের ফুটে আকাশ ছোঁয়া মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির বিল্ডিংটা দেখলেই তার বুকের ভেতরটা যেন চিনচিন করে ওঠে।      কিন্তু মন খারাপ করে যে কোন লাভ নেই। বাবা পরেশ পাড়ুই বলতেন, ‘কপালের লিখন বল বা ভাগ্যের চাকা – কোনটারই নিয়ন্ত্রন আমাদের হাতে নেই’। রতনেরও তাই মনে হয়। না হলে কি আর ওকে মোটর মেকানিক হয়ে জীবন কাটাতে হয়? সারাদিন গ্যারেজে কাজ, তারপর কালিঝুলি মেখে ভূত হয়ে বাড়ি ফেরা। কবে কবে যেন গায়ের রংটাই গেল পালটে। মা বলে, বাবার মতই গায়ের রঙ ছিল ওর। পড়াশুনায়ও দারুণ। বাবার ইচ্ছা ছিল, ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে; রতনও তাই ভাবতো। কিন্তু ভাবলেই কি আর সব হয়? কপালই তো ডাঁড়াশের ইঁদুর গেলার মত মোড়া মেরে ভরে দিল গ্যারেজে। তাই ডাক্তার হয়ার স্বপ্ন, ভাঙলো মোটর মেকানিক হয়ে।      রতনের জীবনে সেই শুরু অসময়ের

জলপট্টি

আলী হোসেনের ছোটগল্প - জলপট্টি সেদিনের কথাগুলো ভাবতে বসলে মায়ার চোখ দুটো ভিজে যায়। সবে সুখের মুখ দেখেছে ওরা। প্রচণ্ড দুর্দিনেও যারা মাটির টানকে উপেক্ষা করতে পারে নি, অসময়টা যখন কাটতে চলেছে, ঠিক তখনই শিকড়টা গেল কেটে। যেন প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস থেমে যাওয়ার মুখেই  লাটাই থেকে সুতটা ছিড়ে গেল। সুত-কাটা ঘুড়ির মত পাক খেতে খেতে দশ-পুরুষের ভিটে ছেড়ে এসে পড়ল কলকাতায়; কংক্রিটের জঙ্গলে। যারা ভরসা দিল, ‘পথের শেষ কোথায়’ দেখাবে, তারা কেমন সরে গেল সেই পথেই কাটা রেখে। পরেশের কথায়, ‘না রিফিউজি হলাম, না পেলাম নিজের জমি-জিরেত বিকিয়ে কেনা জমির দখল’। তাই চোখের কোন থেকে জলের ক্ষরণ কমে গেলেও বুকের ভেতরের গভীর ক্ষত এখনও শুকোয়নি মায়ার। তবে এ ক্ষতে সুস্থতার প্রলেপ পড়েছিল একবার। নয় নয় করে সেও বছর পনের আগের কথা। পরেশ তখন ফুটপাতের সব্জিওয়ালা, রতন ক্লাস ফোর-এ। ‘একখান কথা কইবো’? পরেশ চোখ তোলে। চোখে চোখ রেখে ঘাড় নাড়ে; তার মানে, ‘বলুন’। ‘আপনে কি নতুন বাংলাদেশ থিকা আইছেন’? পরেশ এবারও ঘাড় নাড়ে, মানে, ‘হ্যাঁ’। তোমার লগে কতা কইয়া, চাল-চলন দেইখ্যা তো লেহাপড়া জানা মনে অইতাছে। আজ্ঞে, ইন্টারমিডিয়েট পাস। চাকরি কোরবা? পরেশ মাথ