সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

খালি চেয়ার

খালি চেয়ার - আলী হোসেন

এই আছে এই নেই। সংসারের অমোঘ নিয়মে অহরহই ঘটে এমন ঘটনা। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটলো। দু’দিন আগেও আমি ছিলাম, কিন্তু আজ আর নেই। এই তো, এই হল আমার চেয়ার। আমি মানে নিখিলেশ সাধু। আর-সকলের নিখিল। আমার চেয়ারটা যে ফাঁকাই পড়ে আছে দেখছি! কেউ কি বসে না এখানে? কেন? আমি কি ওদের কাছে অচ্ছুৎ হয়ে গেলাম? না না, এমন ভাবতে পারে, মনে হয়নি তো কখনও!

আয়তাকার তিনটি টেবিল লম্বালম্বি করে বসানো। দৈঘ্য বরাবর দু’পাশে পরপর চেয়ার পাতা। সেখানেই সবাই বসে। প্রস্থ বরাবর পুবদিকে আমি, আর আমার উল্টোদিকে সুমন। আমার ডানদিকে দৈর্ঘ্য বরাবর বসে সীমা। দারুন সেজেগুজে অফিসে আসে আজকাল। চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় খুবই সাদামাটা ছিল, আর পাঁচটা মেয়ের মতই। বয়স চল্লিশের কোটা যখন ছুঁই-ছুঁই, সাজগোজের বহরটা হঠাৎ বেড়ে গেল। উগ্র না হলেও নারী-স্বাধীনতা বিষয়ে বেশ সচেতন। আমি জানি, এরা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে। বিশেষ করে সীমা। হতে পারে সেটা আমার পেটরোগা দুর্বল শরীরের জন্য। হতে পারে মেয়েদের সহজাত করুণাশ্রিত আবেগই তার কারণ। আমি ভাবি, ব্যাক্তি-কেন্দ্রিক নগরজীবনে সেটাই কি কম?

ও-ও-ই ওই-যে দক্ষিণ পাশে শর্ট হাইটের গাট্টাগোট্টা চেহারার মানুষটা, ওর নাম প্রেম নাথ। মজা করে সবাই বলে, মানে এমন করে উচ্চারণ করে, যেন শোনায় প্রেম-অনাথ। কারণ, প্রেম করে বিয়ে করে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা টেকে নি। বউ তাকে ছেড়ে অন্যের সাথে পালিয়েছে। কিন্তু মানুষটার একটা ভালো গুণ আছে। ভীষণ বই পাগল। খেলা থেকে রাজনীতি, বিজ্ঞান থেকে ইতিহাস সব বিষয়েই তার সমান আগ্রহ। সিনেমা আর নাটক বলতে তো অজ্ঞান। এই দু’বিষয়ে তার যে অনায়াস চলাফেরা তা তার অতিবড় নিন্দুকও স্বীকার করে।

চেয়ারের বামদিকে যারা বসে আছেন, তারা প্রায় সবাই মহিলা। ডান পাশেও তাই। যেন দু’পাশ  সখি-ঘেরা সুদর্শন কৃষ্ণ আমি। তবে একথা আমি মানি, কৃষ্ণের ন্যায় সুপুরুষ কিম্বা রাবণের পুত্রের মত অতিকায় বলশালী আমি নই। কথায় বলে না, ভগবানের মার দুনিয়ার বার। আমাকে এমন মার মেরে ইহ-জগতে পাঠিয়েছেন তিনি, যে আমার মেরুদণ্ড থেকেও নেই। ভাবতেই পারবেন না, একটা চৌদ্দ ইঞ্চি সিআরটি মনিটর চাগিয়ে নেওয়ার মত ক্ষমতাও আমার নেই। এই গোপন তথ্যটা, যা আমার পৌরুষের ঘাড়ে মস্ত বড় প্রশ্ন চিহ্ন বসিয়ে দিয়েছে, তা সুমন যেদিন ফাস করলেন, সেদিন সকলে অবিশ্বাসের হাসি হেসেছিল। আসলে ছোট বেলা থেকেই অগ্নাশয়ের প্রদাহে ভুগি আমি। খাওয়া দাওয়ায় তাই নিদারুণ বিধিনিষেধ। নিয়ম ভাঙলেই অসহ্য যন্ত্রনা হয় পেটে। চৌত্রিশ বছরের যুবক আমি, পেটের ব্যাথায় কেন্নর মতো গুটিয়ে যাই।

আর একজন আছে, যে আমাকে খুব ভালোবাসে। হ্যাঁ, মনীষা। এখানে নেই। কিন্তু সব সময় আমার সাথে থাকে, ছায়ার মত। খুবই কাছের মানুষ ও। বছর ঘুরতেই ও আমাকে উপহার দিয়েছে এক ফুটফুটে মনের মানুষ। জীবনের অন্য মানে খুঁজে পেয়েছিলাম ওকে পেয়ে। আর জেনেশুনে ওর মা, মানে মনীষা, আমার মত এক মেরুদণ্ডহীন পুরুষকে জীবনে সবসময়ের সঙ্গি করে নিয়েছিল। ভাবুন তো, তার কথা কি আমি ভুলতে পারি! যদিও দুর্মুখে বলে, বর না হলেও এমন ঘর পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন ঘরের মেয়ে যে এ ঘরে ঢুকতে পেরেছে, সে তো বরের অশক্ত শরীর বলেই না!

কিন্তু দেখুন, একেবারেই অসময়ে গভীর অতৃপ্তি নিয়ে, তাকে অসহায় করে, তার সঙ্গ ছেড়ে চলে এসেছি আমি। আসা ছাড়া উপায়ও ছিল না আমার। প্যাংক্রিয়াটাইটিস সিভিয়ার পর্যায় পৌচ্ছে গিয়েছিল। নেক্রোসিসের বাড়াবাড়ির ফলে সেপ্টিসেমিয়া হয়ে দুষিত রক্ত শরীরের বিভিন্ন অর্গানে ছড়িয়ে গেল। ফল হল, মাল্টি অর্গান ফেলিওর। ডা. সেন এভাবে যখন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, আমার জীবন-সূর্য তখন আস্তে আস্তে অস্তাচলে, আমি ক্রমশ চেতনা হারাচ্ছি।

গয়াসুর একবার ভগবান শ্রীবিষ্ণুর কাছে রব প্রার্থনা করেছিলেন। বলেছিলেন, আমার দেহশিলা স্পর্শমাত্র সুর-অসুর, কীটপতঙ্গ, পাপী-তাপী, মুনি-ঋষি, ভূত-প্রেত, পিশাচ সবাই যেন পবিত্র হয়ে মুক্তিলাভ করে। শ্রীবিষ্ণু তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন। তাই তো গয়াতে গিয়ে পিণ্ডদান মাত্রই অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি ও সদ্গতি হয়। ভাবলাম, একবার মনীষার কাছেই যাই। ও নিশ্চয় আমার কথাই ভাবছে। ও-ই একমাত্র পারে এব্যাপারে উদ্যোগ নিতে। আর খরচাপাতি? বাবা-মা সব ব্যবস্থা করে দেবে। টাকা-পয়সা দেওয়া ছাড়া এই বৃদ্ধ বয়সে ওঁদের কীই বা করার আছে বলুন তো! তাই মনীষাই আমার একমাত্র ভরসা।

ওই তো মনীষা। কী করছে ও? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি। আমার মনের মানুষকে দুধ খাওয়াচ্ছে। বাঁ হাতের তালুর ওপর মাথাটা রেখে আধ-শোয়া হয়ে আছে মনীষা। দুধে ভরা বুকের তলায় ডান হাত দিয়ে দুধের বোঁটাটা ওর মুখে ভরে দিয়েছে। আহা! দেখ দেখ, দুধ ছেড়ে দিয়ে কচি কচি চোখ দিয়ে কেমন জুলজুল করে দেখছে আমাকে? ওর নিষ্পাপ চোখ দিয়ে কেমন অক্ষম পিতার প্রতিচ্ছবি আঁকছে, একটু সোহাগ নেওয়ার জন্য। এমন মানুষকে ছেড়ে আমি থাকবো! হায় ভগবান!

ওই তো, রোজকার মত মা আজও সন্ধ্যারতি দিচ্ছেন। গলায় লালপেড়ে সাদা শাড়ির আঁচল। মনিটা একচোখ জলে ডুবে আছে। আচঁলের এককোনে সংসারের চাবি। আরতির শেষে, শক্ত করে বাঁধছেন। বাঁধছেন আবার খুলছেন, নতুন করে বাঁধার জন্য। কিন্তু কিছুতেই সে-বাঁধন যেন শক্ত হচ্ছে না। কী করে হবে বলোতো মা! তোমার বুকের বাঁধন আলগা করে আমি যে চলে এসেছি; অনেক অনেক দূর। আচ্ছা মা, তুমি কি আজও সাতটা পাঁচের ট্রেনটা স্টেশনে ঢোকার অপেক্ষায় কান পেতে রাখ? জানো মা, আজ আমিও বুঝি, সন্তান কী? তাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট কত।

না না, তুমি কাছে এসো না, ছুয়ো না আমাকে! আমার কথা শোনার আগেই মনীষা বলল। মেঘের প্রকৃতি দেখেই যেমন আবহাওয়াবিদ বলে দেন আজ বৃষ্টি হবে কিনা, তেমনি আমার উপস্থিতিতেই মনীষা যেন জেনে গেছে আমার বলার বিষয়। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। জানলার স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে বাইরে চোখ ফেলুন। ঐ দেখুন, বেল ফুলের ছোট্ট বাগানটা ল্যাম্পোষ্টের আলোয় কেমন ঝলমল করছে। ফুলের গন্ধে এক মায়াবি আবেশ তৈরী হয়াছে ঘরময়। আমিই যত্ন করে লাগিয়েছিলাম বাগানটা। অবশ্য আবদারটা ছিল মনীষারই। গ্রীষ্মের নিদারুন গরমে গাছগুলি যখন মৃতপ্রায়, তখনই বর্ষা আলাদিনের মত প্রদীপ হাতে হাজির হয়েছে। দেখুন দেখুন, আবার বেঁচে ওঠার আনন্দে কেমন নেচে নেচে উঠছে ওদের মন। বৃষ্টির ফোটার তালে তালে আন্দোলিত হচ্ছে ওদের সুগন্ধি শরীর। পাতাগুলোর ছান্দসিক নাচনও তো সে-কারণেই। এমন দিনে আবার নতুন করে বেঁচে ওঠার ইচ্ছা কি অন্যায়? মনীষা বলল, আমি বাঁচতে চাই, নতুন করে বাঁচতে চাই।

ঠিকই তো, মনীষা এই বয়সে স্বামী হারিয়েছে। কতই বা বয়স হবে ওর? কুড়ি থেকে বাইশ, বড়জোর পঁচিশ। বিয়ের কথা ও ভাবতেই পারে।

নিশ্চয় পারে। সীমাকে সমর্থন দেয় প্রেম! বলে রাখা ভালো; এদের মত আমি এ অফিসের স্থায়ী কর্মী নই। পার্ট টাইম কম্পিউটার টিচার। মাত্র দু হাজার টাকা পাই মাস গেলে। বলতে লজ্জা নেই, এই টাকা আমার যাতায়াতেই শেষ হয়ে যায়। তবু কাজটা করি। রুগ্ন মানুষটার এটাই যে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। শুধু বসে বসে কি বাঁচা যায়?

নিশ্চয় পারে, ওকে আটকানো উচিত নয়। সুমনও জোরের সঙ্গে দাবি করে। বলে, তাহলে আমরা মনীষাকে সাহায্য করতে যাবো কেন? আমরা ওকে চিনি নিখিলের স্ত্রী হিসাবে। সেই নিখিলকেই সে যদি ভুলতে চায়, বিয়ে করতে চায় অন্য জনকে, দু’দিন না যেতেই, তাহলে কি ওর মধ্যে কোন মানবিক মুখ আছে? এমন মানুষকে সাহায্য করার বিষয়কে আমি সমর্থন করতে পারিনা। তাছাড়া ও নাকি বাড়ি বেচে নিজের নামে ফ্লাট কিনে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। না না, অন্তত একটু অপেক্ষা করা দরকার আমাদের। ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করা প্রয়োজন। সাহায্য তো আমরা করতেই পারি, যেকোন সময়। এত তাড়াহুড়োর কি আছে?

হ্যাঁ হ্যাঁ, সুমনের কথাটা ভাবার আছে। কয়েকজন সমর্থন করে সুমনকে।

না না না, অতশত ভাবতে যাবো না। একজন অসহায় মানুষের পাশে দাড়াতে চাই, এটাই বড় কথা। সে নিখিলের পরিবারের সঙ্গে থাকলো কি থাকলো না সেটা দেখার দরকার নেই তো। প্রেম যুক্তি সাজায়, যে দেশে বিদ্যাসাগরের মত মানুষের জন্ম, যে-কিনা নিজের ছেলের সঙ্গে একজন বিধবার বিয়ে দিয়েছেন, সেদেশে এমন কথা মানায় না।

সুমন বলল, দেখ প্রেম, বিদ্যাসাগর কিন্তু কোন পুত্র বা কন্যাসহ কোন নারীকে তাঁর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন নি। এখানে বিষয়টা ভিন্ন। এখানে একটা ছ’মাসের কন্যা সন্তান আছে মনীষার। তার ভবিষ্যৎ কী?

সীমা বললেন, ওর ভবিষ্যতের জন্যই তো সাহায্য করতে চাই আমরা। বাচ্চার নামে একটা বিমা করে দিলে...

এতে বাচ্চাটার কোন সাহায্য হবে বলে আমার মনে হয় না; সুমন সীমাকে খণ্ডন করার চেষ্টা করে। ছমাসের বাচ্চার নামে কোন বিমা হয় না, বাচ্চার বয়স কম করে দশ বছর হওয়া প্রয়োজন। এখন বিমা হবে সন্তানকে জড়িয়ে মায়ের নামে। এবং মা বিভিন্ন অজুহাতে সেটা তুলে নিতেও পারে। তার চেয়ে মনীষা যাতে নিখিলের বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে যায় সে-চেষ্টাই করা উচিৎ। কারণ, নিখিলের বাবা-মা মনীষাকে নিজের মেয়ের মতই দেখেন। সেই মতই বাড়িতে থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরাও প্রস্তাব দিতে পারি, মনীষা ও-বাড়িতে থেকে গেলে আমরা ওর পাশে থাকবো। এতে একদিকে বাচ্চা, অন্যদিকে মনীষা এবং নিখিলের বাবা-মা – সবার পক্ষেই মঙ্গল। বিশেষ করে বাচ্চাটার শিক্ষা, বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার সমস্যা কখনই হবে না। উল্টোদিকে ভাব, মা যদি অন্য পুরুষকে বিয়ে করে, আজকের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় বাচ্চাটির শৈশব কি নিরাপদ হতে পারে; একশ-ভাগ গ্যারান্টি দেওয়া যাবে?

কেন হবে না? পৃথিবীতে কি ভালো মানুষ নেই?

সুমন বলল, আছে তো। যেমন তুমি। নারীর অধিকার বিষয়ে বিশেষ সচেতন। তুকি কি পারবে বাচ্চাসহ মনীষাকে বিয়ে করতে? অথবা, যদি বলি, তুমি তোমার ছেলের কথা ভেবে দ্বিতীয়বার বিয়ে করছো না কেন?

প্রেম মাথা নিচু করে।

শোনো প্রেম, মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য কিন্তু যৌন সম্ভোগ নয়। মানুষের আরও কিছু মৌলিক চাহিদা আছে। চাহিদা যেমন আছে, তেমনি কিছু দায়িত্বও থেকে যায়। আজ মনীষার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে তিনটি মানুষের জীবন। নিখিলের বাবার অর্থ আছে। তাই মনীষার প্রতি আর্থিক দায়-দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন। কিন্তু মনীষা ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে নিজেদের প্রতি বা নাতনির প্রতি মনীষার যে কর্তব্য, তা কি কিনতে পারবেন? সুমন ভাবে, পয়সা দিয়ে  দায়িত্ব হয়তো কিছুটা পালন করা যায়, কিন্তু কর্তব্য কেনা যায় না।

অধিকাংশের মত কিন্তু মনীষার দিকেই, প্রেম স্বর নামিয়ে বলে।

আচ্ছা বলুন তো, তাহলে আমাদের মেয়েটার কী হবে? সুমন তো ঠিকই বলেছেন, বাবা-মার সঙ্গে থাকলে... না না, আমি আর ভাবতে পারছি না। তুমি যা বোঝ, তাই কোরো মনীষা...আমার অতৃপ্ত অসহায় মন গুণগুণ করে গেয়ে ওঠে...‘যদি আরও কারে ভালোবাসো / যদি আরও  ফিরে নাহি আসো / তবে তুমি যাহা চাও / তাই যেনও পাও / আমি যত দুখও পাই গো...’ শুধু মেয়েটার দিকে একটু খেয়াল রেখ।

মনীষা পাশ ফিরে শোয়।  আধ-ঘুমের মধ্যে বড় একটা হাই তোলে। ঘুমজড়ানো স্বপ্নিল গলায় বলে, তোমার সন্তান তো মেয়ে। মেয়ে হয়ে সে কিভাবে পিণ্ড দেবে?

নিশ্চয় দিতে পারবে। শ্রীরাম চন্দ্র, লক্ষ্মণ ও জানকী বনে যাওয়ার পর রাজা দশরথের মৃত্যু হয়েছিল, তা তো তুমি জান। একসময় সীতাকুণ্ডে এসে মা জানকী পিণ্ডদান করেছিলেন। তোমার মনে নেই, এ কাজ রাম ও লক্ষ্মণের অলক্ষেই হয়েছিল? হাত বাড়িয়ে সেই পিণ্ডই তো গ্রহণ করেছিলেন স্বয়ং দশরথ। সাক্ষি ছিল অক্ষয়বট, বহমান ফল্গু নদী, গোমাতা, পুরোহিত আর তুলসি। পরে একমাত্র বটবৃক্ষ ছাড়া সবাই মিথ্যা সাক্ষি দিয়েছিল। সেকারণেই তো জানকী ফল্গু নদীকে শাপ দিয়েছিলেন ‘অন্তঃসলিলা হও’। সত্যবাদিতার জন্য বটবৃক্ষকে বলেছিলেন, অক্ষয় হও। তাই তো সে অক্ষয়বট।

জানি

তবে?

ওই টুকুন দুধের বাচ্চা কিভাবে করবে এ কাজ! গলায় প্রশ্নের অসাবলীল উচ্চারণ। মনীষার গলা জড়িয়ে আসছে ঘুমে।

ও তুমি ভেব না। বাবাকে বোলো, সব জানতে পারবে। মেয়ের প্রতিনিধি হয়ে একজন পাণ্ডা কিভাবে পিণ্ডদান করতে পারে...

ও হরি, এতো দেখছি ঘুমে কাদা হয়ে গেল। আমার মনের কথাটুকু শোনার ইচ্ছাটাও হারিয়ে ফেলেছে মনীষা, এই দুদিনেই!

আচ্ছা বলুন তো, মৃত্যু কি মানুষকে এতটা মূল্যহীন করে দেয়! আমি তো ভালোবাসার আষঢ় দেখেছি। আষাঢ়ে আকাশ দেখেছি। দেখেছি মেঘের হঠাৎ হঠাৎ রূপ বদল। শুনেছি, তার মতই মানুষের মনের রূপও নাকি বদলে যায় ক্ষণে ক্ষণে। তাই অবাক হই নি। তবু বুকের ভেতরটা কেমন যেন নড়বড়ে হয়ে গেল। চেয়ারটা ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। প্রেম দেখলো, ফাঁকা চেয়ারটা যেন সহসা নড়ে উঠলো। সিমা বলল, আমিও তো তা-ই দেখলাম! নিশ্চয়ই ওখানে নিখিলের আত্মা ভর করেছে। দু’জনের গলা একসঙ্গে কেপে উঠে, চোখ বড় বড় করে ভয়ার্ত গলায় বলল, নিখিলকে পিণ্ড দিতে হবে, না হলে রক্ষা নেই! চুপি চুপি বলে রাখি, আমার ভালোবাসার এক ক্ষেত্র যদি মনীষা ছিল, তবে অপর ক্ষেত্র এই বিদ্যালয়। তাই অবশেষে তার কোলেই এলাম। এলাম, দেখলাম, তারপর বসলাম খালি চেয়ারটায়। বুঝলাম, সে-ই কেবল বদলায় নি।

*******

রবিবার, 09 জুন 2013

7.44.21 অপরাহ্ন

মন্তব্যসমূহ

রচনাকাল অনুযায়ী গল্প : পড়ুন 👉 এখানে ক্লিক করে

আলী হোসেনের জনপ্রিয় গল্পগুলো পড়ুন

নূরের জ্যোতি

কেমনে রাখবো কুল / পটল গাছে হয়না পটল /  না ছোঁয়ালে ফুল -- সুর করে  গান গাই গল্পটির ইউনিকোড ফন্টে খুব শিঘ্রি প্রকাশিত হবে। অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। Saturday, March 07, 2009 11:20:42 AM Ali Hossain H/O : Asraf Ali Nasker Brahmapur, Battala Bazar ( Near Post Office ) Kolkata-7000 96 Phone: 9432983876

মড়ক - আলী হোসেন

মড়ক আলী হোসেন      কোনটা সময় আর কোনটা অসময়, সময়টা চলে না গেলে যেন বোঝা যায় না। বলা ভালো, ঠিকঠাক বোঝা যায় না। বিজ্ঞজনেরা তো তা-ই বলে। রতন বিজ্ঞজনও নয়, সময়ের গলিঘোঁজ খুঁজে স্বাস্থ্য পরীক্ষাও তার কম্ম নয়। তবে তার সময় যে ভালো যাচ্ছে না, সে বিলক্ষণ জানে। জানে বলেই বোধ হয় বিষন্ন হয় মন, কখনও সখনও ভারিও। বিশেষ করে বাড়ির উল্টোদিকের ফুটে আকাশ ছোঁয়া মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির বিল্ডিংটা দেখলেই তার বুকের ভেতরটা যেন চিনচিন করে ওঠে।      কিন্তু মন খারাপ করে যে কোন লাভ নেই। বাবা পরেশ পাড়ুই বলতেন, ‘কপালের লিখন বল বা ভাগ্যের চাকা – কোনটারই নিয়ন্ত্রন আমাদের হাতে নেই’। রতনেরও তাই মনে হয়। না হলে কি আর ওকে মোটর মেকানিক হয়ে জীবন কাটাতে হয়? সারাদিন গ্যারেজে কাজ, তারপর কালিঝুলি মেখে ভূত হয়ে বাড়ি ফেরা। কবে কবে যেন গায়ের রংটাই গেল পালটে। মা বলে, বাবার মতই গায়ের রঙ ছিল ওর। পড়াশুনায়ও দারুণ। বাবার ইচ্ছা ছিল, ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে; রতনও তাই ভাবতো। কিন্তু ভাবলেই কি আর সব হয়? কপালই তো ডাঁড়াশের ইঁদুর গেলার মত মোড়া মেরে ভরে দিল গ্যারেজে। তাই ডাক্তার হয়ার স্বপ্ন, ভাঙলো মোটর মেকানিক হয়ে।      রতনের জীবনে সেই শুরু অসময়ের

জলপট্টি

আলী হোসেনের ছোটগল্প - জলপট্টি সেদিনের কথাগুলো ভাবতে বসলে মায়ার চোখ দুটো ভিজে যায়। সবে সুখের মুখ দেখেছে ওরা। প্রচণ্ড দুর্দিনেও যারা মাটির টানকে উপেক্ষা করতে পারে নি, অসময়টা যখন কাটতে চলেছে, ঠিক তখনই শিকড়টা গেল কেটে। যেন প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস থেমে যাওয়ার মুখেই  লাটাই থেকে সুতটা ছিড়ে গেল। সুত-কাটা ঘুড়ির মত পাক খেতে খেতে দশ-পুরুষের ভিটে ছেড়ে এসে পড়ল কলকাতায়; কংক্রিটের জঙ্গলে। যারা ভরসা দিল, ‘পথের শেষ কোথায়’ দেখাবে, তারা কেমন সরে গেল সেই পথেই কাটা রেখে। পরেশের কথায়, ‘না রিফিউজি হলাম, না পেলাম নিজের জমি-জিরেত বিকিয়ে কেনা জমির দখল’। তাই চোখের কোন থেকে জলের ক্ষরণ কমে গেলেও বুকের ভেতরের গভীর ক্ষত এখনও শুকোয়নি মায়ার। তবে এ ক্ষতে সুস্থতার প্রলেপ পড়েছিল একবার। নয় নয় করে সেও বছর পনের আগের কথা। পরেশ তখন ফুটপাতের সব্জিওয়ালা, রতন ক্লাস ফোর-এ। ‘একখান কথা কইবো’? পরেশ চোখ তোলে। চোখে চোখ রেখে ঘাড় নাড়ে; তার মানে, ‘বলুন’। ‘আপনে কি নতুন বাংলাদেশ থিকা আইছেন’? পরেশ এবারও ঘাড় নাড়ে, মানে, ‘হ্যাঁ’। তোমার লগে কতা কইয়া, চাল-চলন দেইখ্যা তো লেহাপড়া জানা মনে অইতাছে। আজ্ঞে, ইন্টারমিডিয়েট পাস। চাকরি কোরবা? পরেশ মাথ