সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কর্তব্য

কর্তব্য । আলী হোসেন

রাত হয়েছে অনেক। তবু চোখের পাতা দু’টো এক হচ্ছে না। বুকের ভেতরটাও কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সুদূর, দূর কিংবা নিকট - কোনো অতীতেই এমনটা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না পরানের। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি থেকে যেদিন ভি. আর. এস. নিতে এক রকম বাধ্য হয়েছিলেন, তখনও এমন হয় নি।

বাবা, তোমার শরীর ঠিক আছে তো?

আছে। সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় পরান। উত্তরের ধরণে অভিমান না অনুযোগ, স্পষ্ট বুঝতে পারে না রণো। তবে কিছু যে একটা আছে, সেটা খুব স্পষ্ট। কিন্তু কেন! বুড়িমার মৃত্যুই কি...? কিন্তু এ মৃত্যুকে বিলম্বিত কিম্বা অতিক্রম, দু’ই তো দুঃসাধ্য। আর এবিষয়ে বাবাও যথেষ্ট সচেতন। তাহলে?

পরানের বাবা গত হয়েছেন বহুবছর আগে। বাবার অভাব বুঝতে দেননি মা প্রতিমা। বুকের সাহস কিংবা মনের বল সবকিছুর উৎস ছিলেন তিনিই। পরান বড় হয়ে উপলব্ধি করেছে, মা হচ্ছেন নোঙরের খুটির মত। না হলে টোকা শ্যাওলার মত কবেই সে ভেসে যেত অথৈ সাগরে।

বেশ ক’দিন হল শরীরটা ভালো যাচ্ছে না বুড়ির। নাতি রণো, বুড়ি বলেই ডাকে প্রতিমাকে। বয়স তো আর কম হল না। নয় নয় করেও নব্বই। অত বড় একটা মারণ-রোগ নিয়েও যে এত স্বাভাবিক থাকা যায়, প্রতিমাকে না দেখলে কারও বিশ্বাসই হবে না। মুকির কাচে অমন ক্যান-চার ক্যান-চার করিস নি তো, ক্যান চার তার মুই কি জানি। আমি জানি চার কুড়ি দশ হবে বোশেক পেরুলি। ঢুকিচি ন’বচরে, আর ভালনাগে না এ সংসার। একন তোদের দিন, তোরা ঘুরগে।

শেষ বয়সে একটু ঘুরবি নে? শুধু তো খেটেই গেলি। কতকিছু দেখার আছে দুনিয়ায়। দেখেছিস কিছু? কত সুন্দর সুন্দর জিনিস রয়েছে কলকাতায়, মন্দিরও আছে। যাবি একদিন?

মন্দিরের কথা শুনলে প্রতিমার ভেতরটা অস্থির হয়ে ওঠে।  সত্যি কথা বলতে কি, সংসারের চাপে ঠাকুরকে সেভাবে ডাকা হয় নি কোনদিন। অনেক সাধনায় যেন শিবের মত বর পেয়েছিল প্রতিমা। তাকেই শিবজ্ঞানে পুজো করেছে। স্বামী-সেবাকেই ধর্ম ভেবেছে, আর সংসারকে কর্ম। সেই শিবই যখন ছেড়ে গেল অসময়ে, তখন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি তার উদাসীনতা গেল আরও বেড়ে। বাবা অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ধর্মকে আফিম ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে তিনি রাজি ছিলেন না। হয়তো বাবার ধর্মচেতনা অজান্তেই তার মনের উপর প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু শেষ বয়সে এসে মনের সেই খোলা আকাশে জমাট বেঁধেছে এক গাঢ় ধোঁয়াশা। সেই ধোঁয়াশা কাটিয়ে মুক্ত আকাশে অনন্ত বিহারের মত দার্শনিক তত্ত্বের যোগান ক্রমশ কমে এসেছে। চোখ বন্ধ করলেই ইহজগতের অসারতা প্রকট হয়ে উঠছে, যাকে অতিক্রম করার মত কোন যুতসই বস্তুবাদি ব্যাখ্যা নেই প্রতিমার কাছে। তাই পরলৌকিক জীবনের প্রতি অবিশ্বাসের ‘অ’-ও ক্রমশ অদৃশ্য হতে হতে বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। শেষমেশ রণোকে বলেই ফেলে, চল তালে, একদিন যাই। আর ক’দিন বাদে যখন ঠাকুরের পায়েই আশ্রয় নিতি হবে......

রনো হাটছে। পাশাপাশি প্রতিমাও। অবশ্যই রনোর বাঁ-হাতে প্রতিমার ডান হাত। গড়িয়াহাট ওভারব্রিজের নিচে এসে রণো বলল, এই নে বুড়ি, দুটো টাকা। প্রণামি দিবি। ঐ যে সুন্দর চকচকে ঘরটা দেখছিস, গেটে একজন বসে আছে না; ওর হাতে দিবি। তারপর ঘরে ঢুকে...

বা! সন্দর তো। রণোর কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রতিমা বলে, এ মন্দিরটার নাম কিরে ভাই?

মুহূর্তে রণোর মাথায় খেলে যায় দুষ্টুবুদ্ধি। বলে, দেখে আয়, তারপর বলছি।  প্রতিমাকে পাঠিয়ে একটি সিগারেট ধরায় রণো। নিজের চাকরির পয়সায় কেনা প্রথম সিগারেট, তাই তৃপ্তিই আলাদা। গ্রাজুয়েশন শেষ করেই এস এস সি তে বসেছিল। আর বসেই কিস্তিমাত। এত কম বয়েসে স্কুলের চাকরি, তাই তৃপ্তির সঙ্গে জুড়ে যায় অন্য এক অনুভব। কিন্ত হঠাৎ কানে আসে বুড়ির চিৎকার, দেকদিনি শালা ঢেমনার কাজ, এই হারামি, এই তোর মন্দির। ছ্যা ছ্যা ছ্যা, ছ্যা! সারা ঘরে পেস্বাবের গন্ধ। ধাড়ি ধাড়ি মেয়েগুলোন নজ্জাশরমের মাতা খেয়ে...

রণো বুঝে যায় খিট-খেয়ে গেছে বুড়ি। সুলোভ সৌচাগারের জৌলুস দেখে মন্দির বলে ভুল করে ঠোকে গেছে। হ্যায় ভগবান! তোর ঘর চেনার খ্যামতাও মোর নি। এমনই পাপি আমি! নাতির প্রতি অভিমান ফেটে পড়ে নিষ্পলক চাহনি আর নিরুত্তর অবয়বে। কিভাবে সামলাবে এবার। শেষমেশ অনেক গুলগপ্প দিয়ে ম্যানেজ করেছিল রণো। যদিও সত্যিকারের কোন মন্দিরে সেদিন আর ঢোকাতে পারে নি বুড়িকে। নেওয়াতে পারে নি তার প্রথম চাকরির টাকায় কেনা কোন উপহার।

সেই বুড়ি আজ শয্যাশায়িনী। একটু আগেই ইহলোক ছেড়েছেন তিনি। এখন রাত দ্বিপ্রহর। পরাণ তাই মাথার পাশে বসে চোখের পাতা দুটো এক করার চেষ্টা করছে। আর রণো ভাবছে, কিভাবে মুহূর্তের দুষ্টু বুদ্ধি মজার কারণ না হয়ে বিড়ম্বনা ডেকে এনেছিল তার জীবনে। তারপর কি করে যেন দুরত্ব তৈরি হয়েছিল দু’জনের মধ্যে। রণোও এড়িয়ে চলত বুড়িকে, বুড়িও হয়তো রণোকে। তবে হ্যাঁ, সেদিন বুড়িমা উপহার নিতে অস্বীকার করলেও আজ আর সেই ক্ষমতা নেই তার। মূলত এই ভাবনা থেকেই রণো বাবা পরাণের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাজার পাঁচেক টাকা হাতে নিয়ে বলে, ঠাম্মার শেষ কাজের দায়িত্বটা আমি নিতে চাই।

কেন? তুমি নেবে কেন?

রণো বলে, ঠাম্মার প্রতি আমার তো কিছু কর্তব্য আছে।

কর্তব্য! টাকা দিলেই বুঝি কর্তব্য পালন হয়ে যায়!

না মানে...

কোনো মানে নেই রণো। মা যখন আমার, তখন দায়িত্ব-কর্তব্যও আমার।

আমারও তো ঠাম্মা।

বা! বেশ বলেছ তো! ছ’মাস হল বিছানায় পড়ে আছেন মানুষটা। একদিনও জিজ্ঞেস করেছিস, ঠাম্মা কেমন আছো? ওষুধ খাইয়েছিস কোনদিন, কাছে বসে! অসহ্য যন্ত্রণায় যখন কাতরেছে, কই, একদিনও তো পাশে বসে মাথায় হাত রাখিস নি? জিজ্ঞেস করিস নি, ঠাম্মা, তোমার কি খুব কষ্টো হচ্ছে?

রণোর মাথাটা নিচু হয়ে আসে। আমি কি তবে, টাকা আর কর্তব্যকে সমার্থক করে ফেললাম! কর্তব্য শব্দের জন্ম তো টাকার গর্ভগৃহে নয়! বাবা কি এজন্যই...

********

২৩/০৫/২০১২

মন্তব্যসমূহ

রচনাকাল অনুযায়ী গল্প : পড়ুন 👉 এখানে ক্লিক করে

আলী হোসেনের জনপ্রিয় গল্পগুলো পড়ুন

নূরের জ্যোতি

কেমনে রাখবো কুল / পটল গাছে হয়না পটল /  না ছোঁয়ালে ফুল -- সুর করে  গান গাই গল্পটির ইউনিকোড ফন্টে খুব শিঘ্রি প্রকাশিত হবে। অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। Saturday, March 07, 2009 11:20:42 AM Ali Hossain H/O : Asraf Ali Nasker Brahmapur, Battala Bazar ( Near Post Office ) Kolkata-7000 96 Phone: 9432983876

মড়ক - আলী হোসেন

মড়ক আলী হোসেন      কোনটা সময় আর কোনটা অসময়, সময়টা চলে না গেলে যেন বোঝা যায় না। বলা ভালো, ঠিকঠাক বোঝা যায় না। বিজ্ঞজনেরা তো তা-ই বলে। রতন বিজ্ঞজনও নয়, সময়ের গলিঘোঁজ খুঁজে স্বাস্থ্য পরীক্ষাও তার কম্ম নয়। তবে তার সময় যে ভালো যাচ্ছে না, সে বিলক্ষণ জানে। জানে বলেই বোধ হয় বিষন্ন হয় মন, কখনও সখনও ভারিও। বিশেষ করে বাড়ির উল্টোদিকের ফুটে আকাশ ছোঁয়া মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির বিল্ডিংটা দেখলেই তার বুকের ভেতরটা যেন চিনচিন করে ওঠে।      কিন্তু মন খারাপ করে যে কোন লাভ নেই। বাবা পরেশ পাড়ুই বলতেন, ‘কপালের লিখন বল বা ভাগ্যের চাকা – কোনটারই নিয়ন্ত্রন আমাদের হাতে নেই’। রতনেরও তাই মনে হয়। না হলে কি আর ওকে মোটর মেকানিক হয়ে জীবন কাটাতে হয়? সারাদিন গ্যারেজে কাজ, তারপর কালিঝুলি মেখে ভূত হয়ে বাড়ি ফেরা। কবে কবে যেন গায়ের রংটাই গেল পালটে। মা বলে, বাবার মতই গায়ের রঙ ছিল ওর। পড়াশুনায়ও দারুণ। বাবার ইচ্ছা ছিল, ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে; রতনও তাই ভাবতো। কিন্তু ভাবলেই কি আর সব হয়? কপালই তো ডাঁড়াশের ইঁদুর গেলার মত মোড়া মেরে ভরে দিল গ্যারেজে। তাই ডাক্তার হয়ার স্বপ্ন, ভাঙলো মোটর মেকানিক হয়ে।      রতনের জীবনে সেই শুরু অসময়ের

জলপট্টি

আলী হোসেনের ছোটগল্প - জলপট্টি সেদিনের কথাগুলো ভাবতে বসলে মায়ার চোখ দুটো ভিজে যায়। সবে সুখের মুখ দেখেছে ওরা। প্রচণ্ড দুর্দিনেও যারা মাটির টানকে উপেক্ষা করতে পারে নি, অসময়টা যখন কাটতে চলেছে, ঠিক তখনই শিকড়টা গেল কেটে। যেন প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস থেমে যাওয়ার মুখেই  লাটাই থেকে সুতটা ছিড়ে গেল। সুত-কাটা ঘুড়ির মত পাক খেতে খেতে দশ-পুরুষের ভিটে ছেড়ে এসে পড়ল কলকাতায়; কংক্রিটের জঙ্গলে। যারা ভরসা দিল, ‘পথের শেষ কোথায়’ দেখাবে, তারা কেমন সরে গেল সেই পথেই কাটা রেখে। পরেশের কথায়, ‘না রিফিউজি হলাম, না পেলাম নিজের জমি-জিরেত বিকিয়ে কেনা জমির দখল’। তাই চোখের কোন থেকে জলের ক্ষরণ কমে গেলেও বুকের ভেতরের গভীর ক্ষত এখনও শুকোয়নি মায়ার। তবে এ ক্ষতে সুস্থতার প্রলেপ পড়েছিল একবার। নয় নয় করে সেও বছর পনের আগের কথা। পরেশ তখন ফুটপাতের সব্জিওয়ালা, রতন ক্লাস ফোর-এ। ‘একখান কথা কইবো’? পরেশ চোখ তোলে। চোখে চোখ রেখে ঘাড় নাড়ে; তার মানে, ‘বলুন’। ‘আপনে কি নতুন বাংলাদেশ থিকা আইছেন’? পরেশ এবারও ঘাড় নাড়ে, মানে, ‘হ্যাঁ’। তোমার লগে কতা কইয়া, চাল-চলন দেইখ্যা তো লেহাপড়া জানা মনে অইতাছে। আজ্ঞে, ইন্টারমিডিয়েট পাস। চাকরি কোরবা? পরেশ মাথ