আলী হোসেনের ছোটগল্প । দায় ।
দুপুরের ঝাঁ-ঝাঁ রোদের তেজ কিছুটা কমেছে। রোদের উজ্জ্বলতা নেই, একটু আগে যেমন ছিল। সবেমাত্র শেষ হয়েছে জোহরের আজান। কি হিন্দু, কি মুসলমান - সকলেই কাজের ছুটি করে ঐ আজান শুনে। অভ্যাসটা এমন, আজানের আওয়াজ কানে যেতেই পেটের নাড়ি মোচড় দিয়ে ওঠে। প্যাভলভের প্রতিবর্তক্রিয়ার প্রভাব অজান্তেই অনুভব করে সেলিম। এক অদৃশ্য টানে, পায়ের ধাপ অনেকটা লম্বা হয়ে যায় ওর।
সেলিম হন হন করে হাটতে থাকে, বাড়ির পথে। মাথায় আনকোরা নতুন টোকা। গত হাটে কেনা। পাট খেতের যা গরম, মাথার ওপর একটু ছায়া না থাকলে প্রাণটা যেন আই-ঢাই করে। রবিবারের হাট খরচ থেকে বাঁচিয়ে তাই এটা কেনা। হাতের নিড়ানিটা চকচক করছে। সূর্যের আলো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে নিড়ানির পাতায় ঘা খেয়ে। সেলিম থেকে থেকে অকারণেই যেন চোখ ফেলছে এই চকচকে নিড়ানির ডোগায়।
বাঁহাতে মাথার টোকাটা খোলে সেলিম। সঙ্গে একটি স্বস্তির প্রশ্বাস ফেলে শব্দ করে। বসত বাড়ির চালের সঙ্গে খড়ের চাল লাগিয়ে তৈরি রান্না ঘর। তারই বেরিয়ে পড়া বাঁশের গায়ে ঝুলিয়ে রাখে সেটি। নিড়ানিটি চালের বাতায় গুঁজতে গুঁজতে হাঁক দেয়, ‘কই, কনে গেলি’। কাঁধের গামছাটা ভাঁজ করে পাখার মত বুকের কাছে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, ‘তেলটা আর গেলাস-খানি পানি দেদিনি’। আনমনে বলে, ‘বাব্বা, কি সব্বনেশে গরম প’ড়চে, পেরাণটা যেন বেরগে যাচ্চে’।
শাশুড়ি ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘খোদাতলা থানে বসে কানে শুনেচে। সন্তান হারানোর শোক কেমন দ্যাকো। দশ মাস দশ দিন পেটে ধরে, গু-মুত কেটে ছেলে মানুষ করলুম। আর সেই ছেলেকে তুই পর করে দিলি! আল্লা তোর শাস্তি দেবে না তো কি মোর শাস্তি দেবে? ওরে আমার বুঁচি বু রে, তুই কি করে আমায় ফেলে গেলিরে।
এক গ্লাস জল আর প্রায় শূন্য তেলের বোতল নিয়ে সামনে দাঁড়ায় সালমা। মুখটা যেন তার অস্বাভাবিক মলিন। কোনো এক অজানা আশঙ্ক্ষায় আচ্ছন্ন যেন চোখমুখ। সেলিম ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নেয় । মনে হল, মরুভুমির বুকে যেন এক গ্লাস জল ঢালা হয়েছে। শুখনো মুখটা গামছায় মুছে সালমার দিকে তাকায় সে, 'এট্টু ঠাণ্ডা পানি দিতি পাল্লি নে! কেমন মেয়েলোক রে তুই। মদ্দালোকের খেদমত কত্তিও শিকিসনি?'
সালমা কথা বলে না। নিঃশব্দে তেলের বোতলটা এগিয়ে দেয়। কাঠ-ফাঁটা রোদে তেঁতে-পুড়ে এয়েচে মানুষটা। একটু বিশ্রাম দরকার। সাতপাঁচ ভেবে ছোট মেয়ের অসুস্থতার কথাটাও চেপে যায়। সকাল থেকে কোথায় না ছুটেছে। 'সাত-আট বার পাতলা পায়কানা করে মেয়েটা যেন নেতকে পড়েচে, মনে মনে স্বগতোক্তি করে, ভাগ্যিস খিচড়ির ইসকুলের দিদিমনিটা এয়েলো! ওর কতামতন নুন-চিনির পানি খেবগে তবে না মেয়েটা চোখ তুলে চেয়েচে।' আনমনে বিড়বিড় করে, 'যাবার সময় বলে গেচে নুন-চিনির পানি, ভাতের ফ্যান এসব খাবাতি যে ভুল না করি। যতবার পায়কানা করবে, ততবার খাবাতি হবে। তাতিও না হলি, ডাক্তার বাড়ি নে যাতি হবে।'
তেল কেরাম খরচ করিস? তেলের বোতলটা সশব্দে মাটিতে রাখে সেলিম। তেলচিটে গামছাটা কাঁধে ফেলে রওনা হয় পুকুরের ঘাটে। বাড়ির মেয়ে মানুষ বেহিসেবি হলি কি সংসার চলে? - মনে মনে গজ গজ করে, দেকে দেকে এমন শোরও গলায় ঝুলগে দেলে বাপ; জীবনে সুক পেলুম না।
কথাগুলো বলতে বলতে সেলিম ক্রমে বাড়ির সামনের কলাবাগানের আড়ালে চলে যায়। সেখানেই স্নানের পুকুর। পুকুরে নামতেই দেখে আদরের হুলো বেড়ালটা মরে পড়ে আছে। সেলিমের বুকটা টনটন করে ওঠে। 'বোদয়, পানি খাতি এয়েলো গো!' তার দেহের অর্ধেকটা জলে, অর্ধেকটা ডাঙায়।
সেলিমের এধরণের বকাবকি নতুন না। অভাবের সংসার। ভুল বোঝাবুঝি লেগেই থাকে। তাই বলে সেলিম তাকে কম ভালোবাসে না। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে সালমা। অতীতের সুখসাগর থেকে মনের মুক্ত খোঁজার চেষ্টা করে রোজকার মত।
তখন সবে বছর দুই বিয়ে হয়েছে ওদের। সেলিমের মা বলল, ‘বৌমা, ওপাড়ার ভোলার শয়ুর, ভোলাকে এট্টা অ্যালে (র্যালে) সাইকেল, সঙ্গে এট্টা নঙিন টিবি দেচে। আমার সেলিমকেও দিতি হবে। বাপকে বোলো’।
শাশুড়ির হাতে ছাগলের দড়ি ধরা। একটি লিকলিকে মাদি ছাগল, অন্যটি দুলদুলে খাসি। মাঠে নিয়ে যাচ্ছে চরাতে। যাওয়ার পথে বাধা পেয়ে অস্বস্থি পাচ্ছে খাসিটা। তাই থেকে থেকে কর্কশ স্বরে ডাকছে, আর ইতি উতি চাইছে। পিচ করে পানের পিক ফেলে সাবুজান। ছাগল দুটোকে গালাগাল দিয়ে বলে, ‘চুপ করনা উলাউটো। একটা দরকারি কতা বলচি, দেকচিস নে?’
সালমা কিছু বলতে যাচ্ছিলো। বাঁধা দিয়ে শাশুড়ি বললো, 'ভোলার তো ঐ ছিরি। বাস করার জন্যি, আঙুলের একটা গিট দেখিয়ে বলে, এইটুকুন জমিও নেই। থাকে পরের ভিটেয়।' খাশি ছাগলটা সাবুজানের হাঁটুতে সজোরে গুঁতো দেয়। ‘দূর মহাবেদ্দি, তোর আবার কি করলুম’। একটু সরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘শোনো বৌমা, ভোলা যেদি এত পায় সেলিম পাবে না কেন? সেলিম তো আমার সোনার টুকরো ছেলে।'
সোনার টুকরোই বটে। গরীবের ঘরে এমন হিস্টোপুষ্ট ও সুদর্শন ছেলে খুব কম দেখা যায়। সালমাও কম যায় না। পাড়ার লোকে বলাবলি করে, সেলিমের বৌটার যেমন রূপ, তেমন গুণ। আর মেনগেছেও দারুণ। যেন একজোড়া কপোত-কপোতি।
সেলিমের ঘরের ভিতরটা বেশ ফাঁকা। বিশেষ কিছু নেই। আসবাব বলতে বাঁশের তৈরী একটা ‘ওটা’, শোয়ার জন্য। কোণের দিকে গুটিকতক মেটে হাঁড়ি, কয়েকটা মাটির কলসি। তাতে কিছু মাঠ-কুড়ানি ধান। ঘরের ভিতর লম্বালম্বি টাঙানো একটি বাঁশের ভারা। তাতে কিছু কাপড়-চোপড়। ‘ওটা’র তলায় রাখা একটা প্রায় আনকোরা নতুন বাক্স, বিয়ের সময় কেনা। সেলিম ‘ওটা’র ওপর বসলে সালমা ঘরে ডোকে। হাতে একগ্লাস জল আর তালপাতার পাখা। মার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে করতে ঘেমে উঠেছিল সেলিম। সালমার চোখ এড়ায় নি সেটা। সেলিম গ্লাসটা নিয়ে ঢক ঢক করে জল খেয়ে নেয়। আঁচল দিয়ে পরম যত্নে গা মুছে দেয় সালমা। সেলিম দেখে সালমার চোখের কোণে জল। সেলিম নিঃশব্দে খালি গ্লাসটা নিচে রাখে। সালমার দু’কাঁধ ধরে ‘ওটায়’ বসালে সে স্বামীর কোলে মাথা রাখে। কাঁপা কণ্ঠে বলে, ‘একন কী হবে?’
'আমি তো আচি, সজোরে সালমাকে বুকে চেপে ধরে সেলিম, ভয় কিসির।' মুখের কথার সাথে চোখের জল বাঁধ ভাঙে। টপ টপ করে জল পড়ে সালমার পিঠে। এক অবর্ণনীয় সুখানুভূতিতে তার সমস্ত শরীর যেন শিহরিত হয়ে ওঠে।
‘আচ্চা, বুঁচিকে দেকচি নে তো’। স্নান থেকে ফিরে জিজ্ঞাসা করে সেলিম।
ওর শরীল খারাপ। পাতলা পায়খানা হচ্ছে।
অষুদ আনা হয়েচে?
না।
ক’বার পায়কানা হয়েচে?
অনেকবার। নুন-চিনির পানি খাবাচ্চি, ঠিক হয়ে যাবেনি।
বলি ও বৌমা! তোমার আক্কেলটা কি বলো দিনি? টালির চালের নিচু বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাঁক দেয় সাবুজান, সেই সাত সকালে ছাগলটা মাঠে দে এলুম। তাদের কি একটু জলপানি দিতি নি? দুপুরের ঠা-ঠা রোদে, আমি বুড়ো মানুষ, যাতি পারি?
আমিই বা পারি কি করে মা? সালমা পালটা প্রশ্ন করে।
কেন? সারাদিন কোন কম্মটা করলে শুনি।
বুঁচির যে খুব শরীল খারাব মা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় নুন-চিনির পানি খাবাতি হ’চ্চে।
কেন কি হয়েছে?
সকাল থেকে পাতলা পায়কানা ক’চ্চে।
সাবুজান অবাক হয়ে যান। তার জন্যি বুজি নুন-চিনির পানি খাবাতি হয়! আরে ছুড়িডা তো আরও হেগে হেগে মরে যাবে। যত পানি খাবাবি তত হাগবে। বিজ্ঞের মত বলে, আল্লা রোগ দেচে, আল্লাই ভালো করে দেবে। খতিব সায়েবের কাচ তে এট্টু পানি পড়ে আনলিই সব সেরে যাবে।
কিন্তু খিচড়ির স্কুলের দিদি মনি যে বললে...
দ্যাকো বৌমা, খোদার ওপর খোদকারি করিস নে। কতায় বলে, রাখে আল্লা মারে কে, আর মারে আল্লা রাকে কে! বুঁচিকে কোলে তুলে বলে, তুই একটু ছাগলগুলোকে দ্যাক, আমি বুঁচিকে দেকচি।
একটু বেলা পড়লেই সেলিম বাজারে যায়। সালমা ঘরে ঢুকে দেখে মেয়েটা এখনও ঘুমাচ্ছে। শাশুড়ীর সঙ্গে অশান্তির জন্য তার দিকে নজর দিতে পারে নি। 'ওঠ তো বুঁচিমা। একটু খেয়ে নে। আর কত ঘুমাবি!'
পশ্চিম আকাশে প্রচণ্ড মেঘ। এখনই ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে বোধ হয়। দেখতে দেখতে দমকা বাতাস ধেয়ে আসে। শুরু হয় কালবৈশাখী। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ে ধারে কাছেই। সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি। চমকে ওঠে বুঁচি। বিদ্যুতের আলোয় চোখ খোলে সে। সালমা কোলে তুলে নিতে গিয়ে থেমে যায়। উঠানে মাঠ-কুড়ানি কিছু সিদ্ধ ধান মেলে দেওয়া ছিল। ভিজে যাওয়ার ভয়ে সেগুলি তাড়াতাড়ি জড়ো করে ঘরে তোলে। তারপর বাটিতে একটু দুধ নিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। আদর করে ডাকে, 'বুঁচিমা? ও বুঁচিমা, আর কত ঘুমাবি?' কিন্তু কোনো সাড়া পায় না। বিদ্যুতের ঝলকানিতে সে স্পষ্ট দেখেছে, বুঁচি চোখ খুলে চেয়েছে। তবে সাড়া দেয় না কেন? তবে কি বিদ্যুতের ঝলকানিতেই তার পৃথিবীর আলো দেখা শেষ হয়ে গেল! সালমা ডুকরে কেঁদে ওঠে।
শাশুড়ি ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘খোদাতলা থানে বসে কানে শুনেচে। সন্তান হারানোর শোক কেমন দ্যাকো। দশ মাস দশ দিন পেটে ধরে, গু-মুত কেটে ছেলে মানুষ করলুম। আর সেই ছেলেকে তুই পর করে দিলি! আল্লা তোর শাস্তি দেবে না তো কি মোর শাস্তি দেবে? ...ওরে আমার বুঁচি বু রে, তুই কি করে আমায় ফেলে গেলিরে।
মাটির দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকা টিকটিকি দুটো একসঙ্গে টিকটিক করে ওঠে। সালমা আরও একবার ককিয়ে কেঁদে ওঠে।
--------xx-------
‘নতুন গতি’ ইদ সংখ্যা - ২০০৯ এ প্রকাশিত।
20 February 2009
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন