সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নির্জনে নীল

নির্জনে নীল - আলী হোসেন :

নির্জনে নীল - আলী হোসেনর ছোটগল্প

স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার . কে যেন বলেছিলেন? কিছুতেই মনে করতে পারছেন না স্বরাজের মা। অথচ এই উক্তিটাই তাকে ছেলের নাম রাখার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। বেশ দেশপ্রেম আর স্বাধীনতার গন্ধ আছে নামটায়। অন্য একটা ব্যাপারও কাজ করেছিল তার মাথায়। স্বরাজের ওপর তার অধিকারটা তো জন্মগতই।

কন্সেপটা বেশ নতুন – ভাবে স্বরাজের বাবা। বিরাজ রায়। সত্যিই তো, সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য বাবার ভূমিকা আর কতটুকু! সর্বসাকুল্যে পাঁচ বা দশ মিনিটের মেহনত। তারপর তাকে দশমাস দশদিন ধরে বুকের মধ্যে আগলে রাখে মা। একটা পাখি যেমন বাচ্চার ঠোঁটে ঠোঁট ঢুকিয়ে নিজের টোটায় টোটা ঢুকিয়ে নিজের খাবার বাচ্চাকে দেয়, মাও তেমনি নিজের খাবারের ভাগ দিয়েই তাকে একটু একটু করে বড় করে তোলে। পৃথিবীর পরিবেশের উপযুক্ত করে তোলে।

হ্যা, উপযুক্ত করে তোলে। তবু দেখুন, পৃথিবীর মুখ দেখার মুহুর্তে সে চিলচিত্কারে কেঁদে ওঠে। ডাক্তারি শাস্ত্র নাকি এটাই স্বাস্থ্যকর বলে ভাবে। কারণ, মায়ের গর্ভে সুস্থ থাকলেই একটা বাচ্চা পৃথিবীর সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশের আঁচ পেয়ে ভয়ে কেঁদে ওঠে। গর্ভের যে নিরাপত্তা বলয়ে সে এতদিন ছিল ওই মুহূর্তে সে তা হারিয়ে ফেলে। যে অসুস্থ হয়ে জন্মায়, সে অনেক ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনটা ধরতে পারে না।

বিরাজবাবু লক্ষ্য করেছেন, মায়ের কোলে দিতেই কী এক মায়াবী ছোঁয়ায় বাচ্চাটা শান্ত হয়ে যায়। একেই বলে নাড়ির টান। মায়ের প্রতি সন্তানের, আর সন্তানের প্রতি মায়ের এই টান একেবারেই স্বাভাবিক; কোনো নীতিশিক্ষার প্রয়োজন হয় না এতে।

স্বরাজ ক্লাস টেনে পড়ে। গায়ের রং কালোই বলা চলে। বাবার রংটাই পেয়েছে। স্বরাজের মায়ের তো তা-ই মনে হয়। তার ধারণা, নিজের রংটা স্বরাজের বাবার চেয়ে একটু হলেও ফর্সা। স্বরাজের চেহারাটা বেশ বড়সড়। প্রথম দেখায় কেউ ভাবতেই পারে, কোনো সাতাশ-আঠাশ বছরের যুবক সে। আদতে তা নয়। দিন ধরে হিসাব করলে পনের বছর দুই মাস আঠাশ দিন।

স্বরাজরা থাকে দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়া এলাকায়। পদ্মশ্রী সিনেমা হলের আগেই যে রাস্তাটা বাম দিকে নেমে গেছে, সেটা ধরে একটু এগুলেই স্বরাজদের ফ্লাট বাড়ি। নিচে সার দিয়ে বিভিন্ন ঝা চকচকে দোকান। কী নেই সেখানে? প্রথমেই একটা সাইবার কাফে। তারপর একটা মুদিখানার দোকান। চিরাচরিত মুদিখানার দোকানের সঙ্গে এর বিস্তর ফারাক। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন কনসেপ্ট এসেছে। সাইনবোর্ডে লেখা ‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’। একটু এগোলেই শপিং মল।

এখন তো মলের যুগ। যেখানে সেখানে মলের ছড়াছড়ি। স্বরাজ দেখেছে, মলের নামে বাবার একটা এলার্জি আছে। বাবার ধরণা, এই মলগুলি দেশের খুচরো ব্যবসায়ীদের জীবন-জীবিকায় টান ধরাবে। উল্টোদিকে মা শপিংমল ছাড়া বাজার করতেই চাননা। অন্য জায়গায় বাজার করলে কেমন ব্যাকডেটেট মনে হয়। স্ট্যাটাস নেমে যায়। বাবা অগত্যা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘শপিংমল-এ’ শুনিয়ে যান। লক্ষ্য যদিও পুবদিকের জানালা দিয়ে দিগন্ত ভেদ করে ওঠা সকালের নরম সূর্য; আসল লক্ষ্য মনে হয় মা-ই।

‘মলময় অজস্র পণ্য ভারি কায়দা করে
সাজানো রয়েছে।
তার ভিতরে কোনটা তুমি চাও?
যেটা চাও, সেটা নইলে সত্যিই কি তোমার
সংসার অচল হয়ে যাবে?
------ ------ ----- ------
যার চোদ্দ আনা বাদ দিলেও জীবন
স্বচ্ছন্দে কেটেছে এতকাল’।

চেহারায় বড়, কিন্তু বয়সে ছোট স্বরাজ। সহপাঠীদের অনেকেই দাদা ডাকে তাকে। স্বরাজ মজা পায়। ছোট হয়েও দাদা হিসাবে নামডাক বেশ উপভোগ করে। তবে দাদা ডাকার কারণ শুধুই চেহারা নয়। অন্য একটা কারণও আছে। সহপাঠীরা ভাবে স্বরাজ কম্পিউটারে ওস্তাদ। জানে না এমন কিছু নেই। হার্ড ডিস্ক পার্টিশান করা, ফরম্যাট করা, ও এস লোড করা তো জানেই। মাইক্রোসফট অফিস গুলে খেয়ে ফেলেছে। অফিসের এমন এমন শর্টকার্ট জানে যে স্কুলের কম্পিউটার টিচার পর্যন্ত মাঝে মাঝে ঘোল খেয়ে যায়।
আলী হোসেনের ছোটগল্প - নির্জনে নীল
হ্যালো, স্বরাজ?
হ্যা, বল।
এই দেখ না, হঠাত মাউসটা কাজ করছে না। এপ্লিকেশনগুলো বন্ধ করতে পারছি না। শার্ট-ডাউনও করতে পারছি না। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কাতর কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে ইলা।

ফোনেই ডিরেকশন দেয় স্বরাজ। কন্ট্রোল টিপে ধরে এস বাটন প্রেস কর।
করেছি। অপর প্রান্ত থেকে শোনা গেল।
এবার অল্ট টেপ। এবার এক্স বাটন প্রেস কর। করেছিস? এবার Alt+F4+U কমান্ড দে, শার্ট-ডাউন হয়ে যাবে।
সোহেল ওকে পাত্তা দেয় না। উল্টে ওর চেহেরা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। মনে মনে রাগ হয় স্বরাজের। ভাবে ঠাস করে চড় কসিয়ে দেয়। কিন্তু সাহস হয় না। স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষক তাকে খুবই স্নেহ করে যে। নাইন থেকে টেনে ওঠার সময় আট’শ মার্কসের মধ্যে সাত’শ আশি পেয়েছে। স্বরাজ কোনো ক্রমে পাশ করেছে।

স্বরাজকে নিয়ে মায়ের খুব চিন্তা। বাবাও চিন্তা করে। কিন্তু ধরা যায় না। অথচ কত ভালো রেজাল্ট করত স্বরাজ। ক্লাস সেভেন পাশ করার পর থেকেই যেন কেমন হয়ে গেল।
হবেই তো। স্বরাজের মায়ের দিকে চেয়ে বলে বিরাজবাবু। তখন বারবার নিষেধ করেছিলাম, শুনলে না। জেদ করে কম্পিউটার কিনে দিলে। এখন সামলাও।
কম্পিউটার আবার কী করল?
তার ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। তবে এমন ঘটনা আমার এক কলিগের ছেলের বেলায় ঘটেছে।

মা ভাবে, কথাটা একেবারে ফেলে দেবার নয়। ক্লাস ফাইভ-এ পড়ার সময় কম্পিউটার কেনা। এমন বায়না ধরল যে না দিলে স্কুলেই যাবে না। বাবাকে না পেরে ধরল মাকে। ছেলেদের প্রতি মায়ের যেন কোথায় একটা দুর্বলতা আছে। ছেলরা ঠিক টের পেয়ে যায়। শেষমেশ কিনে দিল।

যে বছর কম্পিউটার দিল, সে বছর থেকেই রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করে। তবে কম্পিউটারের রেজাল্ট? একেবারে ব্রিলিয়ান্ট। হান্ড্রেড এ হান্ড্রেড।

ও মা,
হ্যা, যাই বাবা। রান্নাঘর থেকে উত্তর দেয় স্বরাজের মা। রান্না ঘর তো নয়, যেন আর একটা ডাইনিং রুম। স্বরাজের মা ডাইনিং রুমকে ডাইনিং রুমই বলে। কিন্তু কিচেনকে বলে রান্নাঘর। বলার কারণটা বেশ মজার। স্বরাজের বাবা ছাড়া কেউ জানে না। কিচেন বলতে গিয়ে চিকেন বলে ফেলে। জানে না তা নয়, তবু বলে ফেলে। ভাষাবিজ্ঞানে এটাকে বলে বর্ণবিপর্যয়। স্বরাজের মাও জানে। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মাঝে মাঝেই ভুল হয়ে যায় তার। কিছুতেই সামাল দিতে না পেরে শেষে এই সিদ্ধান্ত।

স্বরাজের ঘরটা দক্ষিণ-মুখি। সঙ্গে একটি বারান্দা। সেটাও দক্ষিণ-মুখি। বক্স খাটটা ঠিক মাঝখানে রাখা। স্বরাজ একাই থাকে। কিন্তু খাটটা ডবল বেডের। ছোটবেলা থেকেই ওর শোয়াটা বেজায় খারাপ। ঘুমের ঘোরে এগোড়-ওগোড় করে। বার কয়েক পড়েও গেছে। একবার তো কপালটা ফুলে আলু হয়ে গিয়েছিল। সি টি স্ক্যান করতে হয়েছিল। তাই বড়সড় খাট।

ভেতরের দেওয়ালে দামি পেইন্ট। সৌখিন আসবাবগুলিও দামি। জানলার ঠিক বামধারে একটি বড় ধরণের কম্পিউটার টেবিল। দশ হাজার টাকা দিয়ে তৈরি করা। কম্পিউটারটা ওই টেবিলেই রাখা। সঙ্গে লাগানো হাইফাই সাউন্ড সিস্টেম। হোমথিয়েটার।

ডলবি ডিজিটাল সাউন্ড ট্রাকের কোনো হলিউডি মুভি চালালে এক অদ্ভুত অনুভুতি হয়। একশান সিরিজের মুভিতে যুদ্ধবিমানগুলি যখন স্ক্রিনের এপাশ থেকে ওপাশে মিলিয়ে যায়, মনে হয় যেন সত্যিকারের কোনো যুদ্ধবিমান বাম দিকের জানালা দিয়ে ঢুকে মাথার অপর দিয়ে ডানদিকের জানালা দিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল।
এ আর রহমানের গান! স্বরাজ বলে, জাস্ট, পাগল করে দেয়। এক অপার্থিব মিউজিকাল আবহ তৈরি হয় ঘরে।

বড় সাইজের গ্লাস হাতে ঘরে ঢোকে মা। হরলিক্সের গ্লাস। তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে স্বরাজ, ওটা আমার খারার দরকার নেই। তোমার প্রয়োজন, তুমি খাও।
খব না বললে হয় বাবা? দিন দিন শরীরটার কী হাল হচ্ছে দেখেছিস?
হ্যা, দেখেছি। দেওয়ালে টাঙানো কালেন্ডারের মস্ত হাতিটার দিকে তাকিয়ে বলে, হাতির মত চেহারা হচ্ছে। দেওয়াল থেকে চোখ তুলে মায়ের চোখে চোখ রাখে স্বরাজ। গম্ভীর হয়ে বলে, অন্য বন্ধুরা দাদা ডাকে। সোহেল কী ডাকে জানো? মোটকা।

মায়ের জোরাজুরিতে স্বরাজ খেতে রাজি হয়। তবে একটা শর্তে। একটা এন সিরিজের মোবাইল দিতে হবে।
মা রাজি হয়ে যায়। ভাবে কটা টাকাই বা দাম। ছেলেটা তো খেয়ে বাচুক।
একটা ডাটা কেবল দিতে হবে। পাচ’শ টাকা দাম।
হবে খন। তুই খা তো।

রাস্তার উপর থেকে প্রচন্ড জোরে হর্ন বেজে উঠলো। দক্ষিণের জানালা দিয়ে চোখ গলায় স্বরাজ। স্কুলের গাড়ি। দ্রুত নেমে আসে নিচে। লিফটে নামা তো। যেন মুহুর্তে স্বর্গ থেকে মর্তে অবতরণ। দশতলা ফ্লাটের আট তলায় থাকে স্বরাজরা। তাই লিফ্ট না হলে চলেই না।

স্বরাজ আজ খুব খুশি। মনটা যেন ফুরফুরে বাতাসে উড়ছে। কতদিনের স্বপ্ন পুরণ হবে। সারাটা ক্লাস অস্বস্তিতে কাটছে। অত্যধিক আনন্দের ক্ষণ আসতে দেরি হলে যে অস্বস্তি হয়, এ তাই। ঘড়ির কাঁটা যেন এগোচ্ছে না। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র বলতে গিয়ে প্রথম সূত্র বলে দিয়েছে। অথচ খেয়াল নেই। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছে সে।

ছুটির পর মায়ের সঙ্গে বের হয়। বিগবাজারে যাবে। ওখানে নাকি মোবাইলের ভ্যারাইটি কালেকশন আছে। দামও ন্যায্য নেয়। মায়ের সিদ্ধান্ত তাই বিগবাজার।

স্বরাজের মাথায় অন্য হিসাব ঘুরছে। মোবাইলের কোয়ালিটি কী হবে। কোন মডেল নেবে। তাতে ব্লুটুথ আছে কিনা। ইন্ফ্রায়েড আছে কিনা। দেখতে হবে কোন কোন ভিডিও ফরম্যাট সাপোর্ট করে। থ্রিজিপি তো থাকতেই হবে। সঙ্গে এভিআই, এমপিফোরও সাপোর্ট করতে হবে। আর হ্যা, অন্তত দু জিবি মেমরি কার্ডের সল্ট থাকতে হবে। আরও বেশি হলে ভালো হয়। বন্ধুদের ওয়ান জিবি। ওদের টপকাতেই হবে।

ইদানিং স্বরাজ চুপচাপ থাকে। বাইরে বিশেষ যায় না। পড়ার ঘরেও বিশেষ দেখা যায় না। কম্পিউটার গেমিং প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। মোবাইলটিই এখন তার সর্বক্ষনের সঙ্গী। পড়ার কথা বললেই রেগে যায়।

একটা অসম্ভব মানসিক যন্ত্রনা বুকটাকে চেপে ধরছে আজকাল। ছেলের পড়াশুনার ক্রমাবনতিই দুশ্চিন্তার কারণ।

কেন এমন হল? সত্যিই কী কম্পিউটারের জন্য এই অবস্থা? তা কেন হবে? আজকের সময়ে একে উপেক্ষা করাও তো মুশকিল। তাছাড়া কম্পিউটারের কাছে ও এখন যায়ই না। কিছুতেই মিলছে না।

প্রেমে পড়ল না তো তোমার ছেলে? স্বরাজের মাকে লক্ষ্য করে বলে বিরাজ।
তাও তো মনে হয় না।
মনে মনে ভাবে, প্রেম করলে তো মন ভাল থাকে। এই বয়সে একটু প্রেম-ট্রেম হতেই পারে।
‘প্রেম করলে এত খিটখিটে মেজাজ হবে কেন?’
‘হতেই পারে। বিরাজবাবু বলে, ‘বনি-বনা না হলে এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়’।
‘বিয়ের আগে প্রেম-ট্রেম করেছিলে নাকি? ল্যাং খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে মনে হচ্ছে!’
না না। বললেন বটে, মুখটা কিন্তু ক্ষণিকের জন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখ এড়ায়নি প্রিয়াংকার।
তবে প্রেমের ব্যাপারে আজকাল ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক বেশি স্মার্ট। প্রেম করা আর ছাড়ার ব্যাপারে অত ছুৎমার্গ নেই তাদের।
আসলে একটা ছেলে ইচ্ছা করলেই একটা বেকার মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু একটা বেকার মেয়ের পক্ষে বেকার ছেলেকে বিয়ে করতে গেলে অনেক ভাবতে হয়। আর্থিক নিরাপত্তার ব্যাপার থাকে। প্রিয়াংকার এটা সব সময় মনে হয়। ইচ্ছা না থাকলেও বেকার প্রেমিককে গুডবাই জানাতে হয়। তার জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছে দু'বার। এজন্য বন্ধু মহলে অনেক দুর্নাম রয়েছে তার।
কিন্তু স্বরাজ তো এখন সবে ক্লাস টেন-এ পড়ে। তার এখন অমন হবে কেন? তাহলে ...!

ক'দিন ধরে অন্য একটা বিষয় মাথায় ঘুরছে। স্বরাজ একাকিত্ব বোধ করছে না তো? বাড়িতে আড্ডা দেওয়ার মত কেউ নেই। না ভাই, না বোন। বিষয়টা বিরাজকে আগাগোড়াই ভাবাতো। কিন্তু প্রিয়াংকাকে রাজি করানো যায়নি।
আজকাল একটা বিদ্ঘুটে ঝোক দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্তের মধ্যে। প্রথম সন্তান ছেলে হলে ওখানেই স্টপ। মেয়ে হলে কেউ কেউ ভাবলেও ছেলের বেলায় মোটেই না।
স্বরাজ পেটে এলে ইউএসজি করার পরামর্শ দেয় ডাক্তার। তাই ক্লিনিকে যাওয়া। ঢোকার মুখেই একটা নোটীশ। এখানে লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় না।
বেশ তাৎপর্যপুর্ণ মনে হয়েছিল নোটিশটি। কিন্তু এখন আর তেমন মনে হয় না।
কেন? প্রশ্ন করে বিন্দাবন। বিরাজের অফিস বন্ধু। কথা হচ্ছিল স্বরাজের ব্যাপারে। কথা প্রসঙ্গেই এই প্রশ্ন।
বিরাজ বলে, ছেলে হলেই যদি দাড়ি টানা হয়, সেও একপ্রকার মেয়ের জন্মকে আটকে দেওয়া নয় কি? এক্ষেত্রে কি নোটিশ দেওয়া হবে? কে দেবে? বিরাজ জোর দিয়েই বলে, আমাদের দ্বিতীয় সন্তান হলে হয় তো স্বরাজের এই সমস্যা না হতেও পারতো।

আজ রবিবার। বিরাজের অফিস ছুটি। স্বরাজের স্কুলও। শোয়ার ঘরে গা এলিয়ে দেয় বিরাজ। মুহুর্তে চোখটা বুঁজে আসে। একটু পরেই প্রিয়াংকা এসে পাশে বসে। বিরাজ বুঝতে পারে প্রিয়াংকার উপস্থিতি। বয়সটা এক দশক আগের হলে অন্য রকম হত। বিরাজ চোখটা খোলে না ইচ্ছা করেই। কেমন যেন এক ঘেয়েমি লাগে। বিকল্পও এখন হাতের মুঠোয়। প্রযুক্তির কল্যাণে।
প্রিয়াংকা জিজ্ঞাস করে, জেগে আছো?
ঘুমের ঘোরটাকে ভাঙতে চান না। তাই গভীর ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে বিরাজ।
প্রিয়াংকা গায়ে হাত দেয়, 'শুনছো, কথা আছে।'
পাশ ফিরে ঘুম জড়ানো গলা করে বলে, 'বলো।'
তোমাকে একটু পপুলার একাডেমিতে যেতে হবে। কাল।
'স্বরাজের স্কুলে?'
হ্যাঁ।
সে তো তুমিই আছো। টিচাররা তো মায়েদের বেশি পছন্দ করে। বিশেষ করে সুন্দরী মহিলাদের। তাছাড়া, এতদিন তো তুমিই সামলালে।
প্রিয়াংকা বলল, 'এবার তো তোমাকেই ডেকেছে। আমি গেলে হবে না।'
কেন?
জানি না। তুমি না গেলে নাকি পরীক্ষায় বসতে দেবে না।

বিরাজকে দেখে টিচাররা ফিসফিস করতে থাকে। চেহারা দেখে বোধ হয় চিনতে পেরেছেন ইনিই বিরাজের বাবা।
একটু পরেই স্টাফ রুমে ঢুকলেন প্রিন্সিপাল। হাতে একটা সিডি আর একটা মোবাইল। মোবাইলটা দেখেই চিনতে পারলেন। কিন্তু সিডি কেন?
বিরাজবাবু, এটা আপনার। মানে আপনার ছেলের। বাড়ি ফিরে দেখবেন। আর চারদিনের মধ্যে জানাবেন, কেন ইস্কুল থেকে আপনার ছেলেকে তাড়ানো হবে না। এবার আসুন।
বিরাজ খানিকটা ঘাবড়ে গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তো বটেই, সেই সঙ্গে সিডিটা দেখে। বিশেষ করে 'এটা আপনার' বলায়। এরা জানলো কী করে! স্বরাজের কাছ থেকে কি?

ইনকাম ট্যাক্স অফিসের বড়বাবু বিরাজ। ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলে। অফিসে নয়, বাড়িতে।
গাড়ি এনএসসি বোস রোড ধরে গড়িয়া গামী। পিছনের সিটে বসে বিরাজ আবিষ্কার করলেন, এক, দু'বছর আগে হারিয়ে যাওয়া নীল ছবির সিডি, যা তিনি ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের সামনের ফুটপাত থেকে কিনেছিলেন। দুই, মোবাইলের মেমোরি কার্ডে অসংখ্য নীল ক্লিপ, যার মধ্যে স্বরাজের গার্লফ্রেন্ডের আপত্তিকর মুহুর্ত। তিন, স্বরাজের ক্রমশ পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়া ও মোবাইল ম্যানিয়ার কারণ।
-----------------xx---------------

লেখার তারিখ ঃ
Wednesday, March 11, 2009
7:41:15 PM

প্রকাশিত হয় - তথ্যকেন্দ্র - মাসিক পত্রিকা
প্রকাশের তারিখ ঃ ০১/০৮/২০০৯

মন্তব্যসমূহ

রচনাকাল অনুযায়ী গল্প : পড়ুন 👉 এখানে ক্লিক করে

আলী হোসেনের জনপ্রিয় গল্পগুলো পড়ুন

নূরের জ্যোতি

কেমনে রাখবো কুল / পটল গাছে হয়না পটল /  না ছোঁয়ালে ফুল -- সুর করে  গান গাই গল্পটির ইউনিকোড ফন্টে খুব শিঘ্রি প্রকাশিত হবে। অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। Saturday, March 07, 2009 11:20:42 AM Ali Hossain H/O : Asraf Ali Nasker Brahmapur, Battala Bazar ( Near Post Office ) Kolkata-7000 96 Phone: 9432983876

মড়ক - আলী হোসেন

মড়ক আলী হোসেন      কোনটা সময় আর কোনটা অসময়, সময়টা চলে না গেলে যেন বোঝা যায় না। বলা ভালো, ঠিকঠাক বোঝা যায় না। বিজ্ঞজনেরা তো তা-ই বলে। রতন বিজ্ঞজনও নয়, সময়ের গলিঘোঁজ খুঁজে স্বাস্থ্য পরীক্ষাও তার কম্ম নয়। তবে তার সময় যে ভালো যাচ্ছে না, সে বিলক্ষণ জানে। জানে বলেই বোধ হয় বিষন্ন হয় মন, কখনও সখনও ভারিও। বিশেষ করে বাড়ির উল্টোদিকের ফুটে আকাশ ছোঁয়া মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির বিল্ডিংটা দেখলেই তার বুকের ভেতরটা যেন চিনচিন করে ওঠে।      কিন্তু মন খারাপ করে যে কোন লাভ নেই। বাবা পরেশ পাড়ুই বলতেন, ‘কপালের লিখন বল বা ভাগ্যের চাকা – কোনটারই নিয়ন্ত্রন আমাদের হাতে নেই’। রতনেরও তাই মনে হয়। না হলে কি আর ওকে মোটর মেকানিক হয়ে জীবন কাটাতে হয়? সারাদিন গ্যারেজে কাজ, তারপর কালিঝুলি মেখে ভূত হয়ে বাড়ি ফেরা। কবে কবে যেন গায়ের রংটাই গেল পালটে। মা বলে, বাবার মতই গায়ের রঙ ছিল ওর। পড়াশুনায়ও দারুণ। বাবার ইচ্ছা ছিল, ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে; রতনও তাই ভাবতো। কিন্তু ভাবলেই কি আর সব হয়? কপালই তো ডাঁড়াশের ইঁদুর গেলার মত মোড়া মেরে ভরে দিল গ্যারেজে। তাই ডাক্তার হয়ার স্বপ্ন, ভাঙলো মোটর মেকানিক হয়ে।      রতনের জীবনে সেই শুরু অসময়ের

জলপট্টি

আলী হোসেনের ছোটগল্প - জলপট্টি সেদিনের কথাগুলো ভাবতে বসলে মায়ার চোখ দুটো ভিজে যায়। সবে সুখের মুখ দেখেছে ওরা। প্রচণ্ড দুর্দিনেও যারা মাটির টানকে উপেক্ষা করতে পারে নি, অসময়টা যখন কাটতে চলেছে, ঠিক তখনই শিকড়টা গেল কেটে। যেন প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস থেমে যাওয়ার মুখেই  লাটাই থেকে সুতটা ছিড়ে গেল। সুত-কাটা ঘুড়ির মত পাক খেতে খেতে দশ-পুরুষের ভিটে ছেড়ে এসে পড়ল কলকাতায়; কংক্রিটের জঙ্গলে। যারা ভরসা দিল, ‘পথের শেষ কোথায়’ দেখাবে, তারা কেমন সরে গেল সেই পথেই কাটা রেখে। পরেশের কথায়, ‘না রিফিউজি হলাম, না পেলাম নিজের জমি-জিরেত বিকিয়ে কেনা জমির দখল’। তাই চোখের কোন থেকে জলের ক্ষরণ কমে গেলেও বুকের ভেতরের গভীর ক্ষত এখনও শুকোয়নি মায়ার। তবে এ ক্ষতে সুস্থতার প্রলেপ পড়েছিল একবার। নয় নয় করে সেও বছর পনের আগের কথা। পরেশ তখন ফুটপাতের সব্জিওয়ালা, রতন ক্লাস ফোর-এ। ‘একখান কথা কইবো’? পরেশ চোখ তোলে। চোখে চোখ রেখে ঘাড় নাড়ে; তার মানে, ‘বলুন’। ‘আপনে কি নতুন বাংলাদেশ থিকা আইছেন’? পরেশ এবারও ঘাড় নাড়ে, মানে, ‘হ্যাঁ’। তোমার লগে কতা কইয়া, চাল-চলন দেইখ্যা তো লেহাপড়া জানা মনে অইতাছে। আজ্ঞে, ইন্টারমিডিয়েট পাস। চাকরি কোরবা? পরেশ মাথ